মঙ্গলবার ● ২৬ জুলাই ২০২২

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩৮; স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩৮; স্বপন চক্রবর্তী
মঙ্গলবার ● ২৬ জুলাই ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ:  রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম-৩

বিদ্রোহী কবির “বিদ্রোহী ”নামক কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারী। কবিতাটি প্রকাশিত হলে দারুণ হৈচৈ পড়ে যায়। এই সম্পর্কে অশোক কুমার মিত্রের লেখা “ নজরুল প্রতিভা পরিচিতিতে” যা লিখেন তার মর্মকথা অনেকটা এইরূপ-, নজরুল ইসলাম মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ে এক বসাতেই লিখে ছিলেন এই বিদ্রোহী কবিতা। টুকরো টুকরো কাগজে লিখেছিলেন কবিতাটি। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসায় গিয়ে রবীন্দ্র নাথের বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে কবি গুরুকে ”গুরুজী গুরুজী” বলে ডাকতে থাকেন নজরুল। নজরুলের ডাক শোনে উপর থেকে উঁকি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলে ছিলেন, “ ষাড়ের মতো চিৎকার করছ কেন, উপরে উঠে এসো। নজরুল বলেছিলেন , গুরুজী আমি আপনাকে হত্যা করবো। আচ্ছা ,তবে উপরে উঠে আস –গুরুজী বললেন। নজরুল তাঁর পেন্সিলে লেখা টুকরো টুকরো কাগজ গুলো থেকে পাঠ করলেন এই কবিতা। নজরুলের আবৃত্তি শোনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন , হ্যাঁ কাজী, সত্যি তুমি আমাকে খুন করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে, বিশ্ব বিখ্যাত কবি হবে , তাতে কোন সন্দেহ নাই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক , ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা করি। কবিতাটি ছেপে দাও। রবীন্দ্রনাথ তখন নজরুলকে আশীর্বাদ করেন। অশোক কুমার মিত্রের ”নজরুল প্রতিভা” বইটিতে এমনই বর্ণনা রয়েছে। তবে মুজাফ্ফর আহমেদ দাবী করেন যে, নজরুল সর্ব প্রথম তাঁকেই পাঠ করে শুনিয়েছেন। মুজাফ্ফর আহমেদের দাবিটি বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। পরে এ বিষয়ে আর একটু আলোচনা করা যাবে।

প্রথমদিকে একবার রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি লিখেন, “ তোমার বাড়ি শুনেছি বর্ধমানে- আমি থাকি তার পাশের জেলাতে, বীরভূমে। যদি পার একবার এসে দেখা করে যেও”। নজরুল সেই চিঠি রক্ষা করে ছিলেন এবং দেখা করতে গিয়েছিলেন। তারপর হতে নিয়মিতই তাঁদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতো।
১৯২৭ সালে একদিকে সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠিতে রক্ষনশীল হিন্দু বিশেষত ব্রাহ্মণ সমাজের একটি অংশ থেকে এবং অপরদিকে মৌলবাদি মুসলমান সমাজের ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্পন প্রভৃতি পত্রিকায় নজরুল সাহিত্যের বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ নজরল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তিনি সকল অসমতাকে সাম্যের দিকে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে ছিলেন। নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ–খ্রিস্টান ,সব কিছুকেই একত্রে এক সমতায় নিতে চেষ্টা করে ছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মেই শুধু নয় ,ব্যক্তি জীবনেও তা বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর সন্তানদের নামকরণও ঠিক সে ভাবেই করে ছিলেন, যেমন-কৃষ্ণ মুহাম্মদ,অরিন্দম খালেদ ( বুলবুল) কাজী সব্যসাচি,ও কাজী অনিরুদ্ধ। ফলে তাঁকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অনেকের আক্রমণের শিকার হতে হয়। তিনি লিখেছিলেন-
”প্রজা হয় শুধু রাজ-বিদ্রোহী, কিন্তু কাহারে কই/ অন্যায় করে কেন হয় নাকো ,রাজাও প্রজাদ্রোহী।” তিনি আরও বলে ছিলেন, “নতুন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙ্গি-শুধু ভাঙ্গার জন্যই ভাঙ্গার গান আমার নয়।” বুঝতে হবে কবি নজরুল কারও আকাঙ্খা বা আদেশ-নির্দেশ শুনে চলার লোক নয়। তিনি চির বিদ্রোহী।
তিনি হিন্দু-মুসলিম মিলনের জন্য কবিতা লিখেন-” মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। তিনি যেমন সর্বহারা লিখেছেন, তেমনি আবার লিখেছেন দারিদ্রর মতো কবিতা। একদিকে ”কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে”, আবার বলছেন, “ হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান”। যা হোক, রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে কোন বৈরীতা না থাকলেও কিছু সংখ্যক সাম্প্রদায়িক লোকের মধ্যে অহেতুক বৈরীতার আগুন জ্বলতো, এখনো জ্বলে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান বলেছিলো, রবীন্দ্র সংগীত বর্জন করুন, আপনারা নিজেরাই রবীন্দ্র সংগীত লিখুন। তৎক্ষনাতৎ উত্তর পেয়ে ছিলো যে, আমরা লিখলে তো সেটা রবীন্দ্র সংগীত হবে না, হবে আব্দুল হাই সংগীত। অর্থাৎ একটির মতো আর একটি লিখা যায় না। যায় নকল করা। উল্লেখ্য যে, তখন ড, সনজিদা খাতুন ও সাথে অন্যরা প্রতিবাদ করে ছিলেন। রবীন্দ্র জয়ন্তি পালনে বাধা এসেছিল। তখন ড, সনজিদা খাতুন ও তার ছায়ানট প্রতিষ্ঠানটি রমনা বটমূলে রবীন্দ্র জয়ন্তি পালন করেন। পহেলা বৈশাখও সেখানে পালিত হতে থাকে। আজ সেই অনুষ্ঠানগুলো বিরাট মহীরূহে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জনের পক্ষে এমন সব বুদ্ধিজীবি জড়িত ছিলেন যে, সেটা ভাবাও যায় না। তাঁরা রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জনের পক্ষে স্বাক্ষরও সংগ্রহ করেছিলেন। আমি তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। যেমন ভাবা যায় না স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপক্ষের কতিপয় বুদ্ধিজীবিদের কথা।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ঠেরও অনেক মিল পাওয়া যায। দুজনেই কোন নেশা করতেন না । যদিও নজরুল ইসলাম প্রচুর পরিমানে চা পান করতেন এবং জর্দা দিয়ে পান খেতেন । একটি রুমে নাকি চা আর পান দিয়ে বাহির হতে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হতো , আর কবি নজরুল গান ও কবিতা লিখতেন অবলীলায়। রবীন্দ্র-নজরুল দুজনেই কবিতা লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন , নাটক লিখেছেন, গান লিখেছেন ,গান গেয়েছেন , গানের সুরও দিয়েছেন এবং অসংখ্য রাগও সৃষ্টি করেছেন। এতো এতো সুর সৃষ্টি করেছেন যে, বাংলা গান আজ বিশ্বের বিস্ময়। আবার দুই জনেই অভিনয়ও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগে ভারতীয়দের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তাঁকে দেওয়া “ নাইট “ উপাধি বর্জন করেন। বহু লেখায় ,গানে ও নাটকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন। আর নজরুলের তো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য বহু লেখা ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। নজরুল জেলখানায় পর্যন্ত অনশন করেন। সরাসরি কবিতায় বলেন, “ এদেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল” ।
( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩৫:১১ ● ৬৮৫ বার পঠিত