মঙ্গলবার ● ২৭ মে ২০২৫

জনসংগ্রামী নেতা মাষ্টার ইমান আলীর ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা

Home Page » শিক্ষাঙ্গন » জনসংগ্রামী নেতা মাষ্টার ইমান আলীর ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা
মঙ্গলবার ● ২৭ মে ২০২৫


 মাষ্টার ইমান আলী

কৃষক আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ এবং বাংলদেশ কৃষক সংগ্রাম  সমিতির সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি , মহান ভাষা সৈনিক ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ মাষ্টার ইমান আলী। তিনি ঝিনাইদহ জেলার ( তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলা) কালীগঞ্জ থানার মল্লিকপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কবিরাজ ওয়ারেজ আলী একজন সমাজসেবক ছিলেন।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন তার নিজ গ্রামের স্কুল মল্লিকপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পরে যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে যশোর মাইকেল মধুসূদন (এম.এম) কলেজে ভর্তি হন। তিনি ছাত্র জীবনেই বিপ্লবী রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন।

১৯৩৬ সালে যশোর জিলা স্কুলে পড়া অবস্থায় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন যশের জেলার ১৯৪৩ সালে মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা বেলায়েত হোসেন ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই ।

১৯৪৭ সালের জুন মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে এক গোপণ জরুরি বৈঠক হয়, সেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, প্রিন্সিপাল হাই, মাষ্টার ইমান আলী সহ ২৮ জেলার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধিবৃন্দ জানতে পারেন দেশ বিভক্তের কথা। সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বাধীন -সার্বভৌম বাংলার (বৃহত্তর) দাবী জানায় এবং শেষ রাত পর্যন্ত সর্বসম্মতি ক্রমে স্বাধীন বাংলার জন্য দলিল তৈরি করা হয়। তারপর স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সবাই কলকতা কে ৪ দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত স্বাক্ষর করে যার যার জেলায় ফিরে স্বাধীন বাংলার জন্য মুভমেন্ট শুরু করেন।

কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে সবাই ঝুঁকে পড়ায় বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন পিছিয়ে পড়ে। তবে গোপনে বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন চলতে থাকে। তার কিছু কাল পর বাঙালির উপর আসে আর এক আঘাত। ভাষার অধিকার হরণের চক্রান্ত, ফুঁসে ওঠে বাঙালি জাতি।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যশোর উত্তাল হয়ে ওঠে। মাইকেল মধুসূদন কলেজে গঠিত হয় ”রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। তিনি সেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসাবে ১৯৪৮ সালের ১১ এবং ১২ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৩ মার্চ হরতালের নেতৃত্ব দেন ও ১৪৪ ধারা ভাঙার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের কারো মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট সফল ও মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত অটল ছিলো।
১৩ মার্চে ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৮ সালে যশোরে প্রথম ” শহীদ মিনার ” নির্মাণে মাষ্টার ইমান আলী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫৬ সালে মাষ্টার ইমান আলী গণতান্ত্রিক পার্টি তে যোগদান করেন। গণতান্ত্রিক পার্টির বিলুপ্তির পর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ন্যাপ)-তে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে যশোরে কৃষক সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয় এ সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড আব্দুল হক, আব্দুল মালেক, মারুফ হোসেন প্রমুখ। এই সভা সফল করতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।

১৯৮০ সালের ২৪ শে জানুয়ারী তিনি বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত্ম তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালের ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারী ৭ম জাতীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে তিনি বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একটি শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

১৯৮৮ সালে যশোর জেলার কেশবপুর-এ ডহুরী বাঁধ কাটার আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনে কৃষক নেতা গোবিন্দ দত্ত শহীদ হন এবং সরোয়ার মাষ্টার, গোবিন্দ সরকার সহ অনেকে আহত হন। ১৯৯০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর খুলনার বিল ডাকাতিয়া আন্দোলন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের বিরোধী আন্দোলন, ভৈরব নদ দখল মুক্ত করার আন্দোলন,১৯৯৩ সালে কৃষকদের ৭ দফা দাবিতে সংসদ ভবন ঘেরাও,১৯৯৪ সালের সন্ত্রাস বিরোধী পদযাত্রা সহ যশোরে শ্রমিক-হোটেল শ্রমিক-দর্জি শ্রমিক-ধাঙড়দের (সুইপার) আন্দোলন, কুষ্টিয়া-রাজবাড়ি-সাতক্ষীরাতে ভূমিহীন কৃষকদের খাস জমির দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারনীর ভূমিকা রাখেন।

১৯৫৯ সালের প্রথম থেকেই তিনি মাইকেল মধুসূদন (এম.এম) কলেজ প্রতিষ্ঠায় জমি সংগ্রহ ও ইমারত নির্মান প্রকল্প কমিটির সদস্য হিসাবে ভূমিকা রাখেন এবং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃতি পান। যশোর সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা,খুলনার পাইকগাছা থানার বেতকাশিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

মাষ্টার ইমান আলী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষক ও কৃষির সমস্যাই মূলত : জাতীয় সমস্যা এ বক্তব্য নিয়ে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন সংগঠিত করেন। আজীবন এ সংগ্রামী নেতা বিশ্বাস করতেন শোষণ মূলক এ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়।
তাই তিনি সকল প্রলোভনের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পশ্চিমা শাসাক,ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ সহ সকল অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। অসংখ্য বার কারাবরণ নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন।
কোন প্রকার লোভ লালসা তাকে, সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জীবনে সর্বদা কৃষক শ্রমিকসহ আপামর মেহেনতি মানুষের মুক্তির পথে লড়াই করে গেছেন।
১৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে এই মহান মানুষের প্রতি  গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই।

লেখকঃ কবি মোজাফফার বাবু ( মাস্টার ঈমান আলীর যোগ্য সন্তান)

কবি মোজাফফার বাবু ( মাস্টার ঈমান আলীর যোগ্য সন্তান)

বাংলাদেশ সময়: ১৩:২০:৫৬ ● ১০৯ বার পঠিত