সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩: স্বপন চক্রবর্তী
মঙ্গলবার ● ১৭ মে ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ:   ( গত নভেম্বর’২১ এর শেষ সপ্তাহে হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া সীমান্তে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার উপর কিছু লিখার জন্য অনুরোধও ছিল। তাই বসে বসে সময় ক্ষেপন করেছি মাত্র। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হেতু সন্নিবেশিত ভুল তথ্য শুধরে দিলে উপকৃত হবো )।

উত্তর বঙ্গের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত এই গ্রামগুলো। সুজলা-সুফলা প্রকৃতির অকৃপণ দান এই গ্রাম গুলোতে এক সময় দেখেছি প্রচন্ড শীতে তামাকের পুলি ( ছোট চারা ) অতি যত্নে নিবিড় পরিচর্যায় বড় করে তুলছেন আমার দেশের বড় সাধক কৃষকগণ। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে তামাকের যত্ন করছেন। ক্ষেতের পাশের কূপ থেকে ছেঁউতি, কুন বা বালতি ‍দিয়ে পানি তুলে তামাক ক্ষেতে সেচ দিচ্ছেন। সেই তামাক কেটে ক্ষেতেই শুকাতে দিতে হতো। পরে বাড়িতে নিয়ে এসে ঘরের চালের ভিতর দিকে সুন্দর সারি সারি করে রেখে দেওয়া হতো অনেক দিন। তখন তামাকের একটা ঝাঁঝ নাকে এসে ঠেকতো। কিন্তু আবার যখন সেই তামাক সুন্দর করে সযত্নে পলিশ করে অতিব চমৎকার ভাবে বৃত্তাকারে উপরি উপরিভাবে সাজিয়ে রাখা হতো তখন খুব একটা সুন্দর গন্ধ এসে নাকে অনুভুত হতো। মনে হতো যে পাকা সবরী কলার গসুঘ্রাণ এসে নাকে লেগেছে। স্থানীয় ভাষায় এই কলাকে মালভোগ কলা বলা হয়। পাইকারগণ এসে তামাক কিনে নিয়ে যেতো। খুব কষ্টকর কাজ। কিন্তু এবার সেটা কম চোখে পড়েছে। তামাকের আবাদকে নিরোৎসাহিত করা হয়, লাভও এখন তেমনটি নেই। ফলে আগের চেয়ে তুলনা মূলক ভাবে তামাক আবাদ একটু কমে গিয়েছে। তবুও দইখাওয়া বাজারে এখনো তামাকের হাট বসে। বৃহত্তর রংপুর এলাকায় তামাককে তাঙ্কু বলে। আগে অনেক বাড়িতে তামাক সেবন করতে দেখা যেতো। এমনকি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বয়স্ক মহিলাদের মাঝেও তামাক সেবন করার দৃশ্য কখনো চোখে পড়তো। কিন্তু এখন তেমনটি আর লক্ষ্য করা যায়নি। প্রচুর প্রচারণার কারণে দেশের সর্বত্রই তামাক সেবন কমে গেছে। তামাক খাবার জন্যও এক সময় দেখা যেতো বেশ রাজসিক আয়োজন। সেটা শুধু বৃহত্তর রংপুর নয়, দেশের সব জায়গায় লক্ষ করা যেতো। সুন্দর করে কাঠের উপর রেখে দা দিয়ে কেটে কেটে কুচি করা হতো তামাক। সযতনে ব্যবহার করা হতো লালী গুড়। স্থানীয় ভাষায় একে কি বলে তা মনে করতে পারছি না। ঝোলা গুড়ও বলে, তবে তামাকে ব্যবহৃত গুড় মুখে খাওয়ার যোগ্য নয়। একটা খাবার জন্য ব্যবহৃত হলেও চিটে তিক্ত স্বাদ যুক্ত একটি লালী গুড় আছে যা তামাক মাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই প্রসঙ্গে এই খাটি গুড় (!) তৈরীর একটি প্রস্তুত প্রণালীর সামান্য বর্ণনা দিতে চাই। যেহেতু সেটা আমাদের সাভারের ঘটনা , তাই বলতে হচ্ছে। টোয়েন্টিফোর নিউজ নামক একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠান একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তাদের বক্তব্যটি এইরূপ- “ খেজুর বা আখের রসের ছিটেফোঁটাও নেই । আছে সারি সারি আটার বস্তা, চিনি,গরুর চর্বি আর রংয়ের মজুদ। চিটাগুড়ের সঙ্গে আটা , চিনি, আর গুড়কে জমাট বাধাতে মেশানো হচ্ছে গরুর চর্বি। সাথে একটু চকচকে করতে দেয়া হচ্ছে বিষাক্ত কাপড়ের রং। এভাবেই তৈরী হয়ে গেল মুখরুচক গুড়। এভাবেই সাভারের নামা বাজারে বেশ কয়েকটি কারখানায় রাতের আঁধারে জালিয়াত চক্র তৈরী করে টনকে টন গুড়। ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে”। যাক, গুড় তৈরীর ফরমূলা শিখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি অতিতের ধুমপান ও তামাক প্রস্তুত প্রণালী নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকি।
অনেক সময় একটু বিলাসী লোকজন খাম্বিরা নামক সুগন্ধিও ব্যবহার করতো- যার সুগন্ধ অনেক দুর হতেও পাওয়া যেতো। হুকা থাকতো প্রতি বাড়ি। ক্ষেতে কাজ করতে গেলে জমির পাশে রাখা হতো হুকা-কল্কি। রংপুরে একে ছিলিম ও হুকা বলে। মেয়েদের চুলের বেণীর মতো করে খড় দিয়ে তৈরী হতো ভুতি। তাতে আগুন জ্বালিয়ে ক্ষেতের আইলে রাখা হতো তামাক খাবার জন্য সব সরঞ্জাম। কেহ নিয়ে যেতেন মাটির ভান্ডে করে আগুন, যাকে বলা হয় আইলা। তামাক খোরদের নিকট তামাক যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় কবতে অনেকে বলে থাকেন- “ অন্ন চিন্তা যেমন তেমন, বস্ত্র চিন্তা নৈরাকার । তার চেয়ে অধিক চিন্তা তামাক ঘরে নাই যার”। অথবা ও পরাণের হুক্কারে, তোর নাম কে রাখিল ডাব্বা”।

এক সময় দেশের প্রায় সর্বত্র দেখা যেতো সবার হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রকাশ্যে ধুমপান চলতো। সাধারণ মানুষের চাহিদা ছিল সাধারণ মানের সিগারেট। যেমন- স্টার, বগা ( কিং স্টর্ক) । আর একটু ভালো জাতের হলে ছিল ব্রিস্টল, সিজর, 555, ক্যাপস্টেন। আবার একটু বিলাসী এবং শহুরে অনেকে আবার মিক্চার তৈরী করে ধুমপান করতো। সেই মিক্চার তৈরীর সরঞ্জাম সাথেই রাখা হতো। কাগজের লেভেলে মিক্চার ঢেলে তারপর সিগারেটের মতো রোল তৈরী করে তাতে আগুন ধরিয়ে আয়েশ করে ধুমপান করতো। মিক্চার ছিল এরিনমোর,ডাচম্যান, ইত্যাদি। ইন্ডিয়াতে তখন সাধারণ মানুষের চাহিদা ছিল চারমিনার সিগারেটের। কুমড়ি পতার বিড়ি ও কাগজে মোড়ানো বিড়িও ইন্ডিয়াতে পাওয়া যেতো। কালেভদ্রে সীমান্ত পার হয়েও চলে আসতো এপারেও। আর একেবরে আমজনতার জন্য অতি সাধারণ ব্যবহার্য ছিল ”নাসা”। এই ”নাসা” তৈরী করা হতো তামাক পাতা গুড়ো করে পুরাতন পত্রিকার কাগজ অথবা নিজ সন্তানের লেখার খাতা হতে ছিড়ে নেয়া কাগজকে রোল আকারে তৈরী করা হতো। তাতে মুখাগ্নি করে আয়েশ করে চলতো নেশা নিবৃত্তির কাজ। উল্লেখ্য, এক জরিপে দেখা গেছে যে, প্রতি বছর তামাক ও তামাক সংশ্লিষ্ট নেশায় বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬২ হাজার মানুষের মৃত্যূ ঘটে। তামাক, সিগারেট, জর্দা এই সব কিছুই তামাকজাত পণ্য। এ থেকে মুখে , গলায় ও অন্ত্রে ঘা হয়।। এই ভাবেই ক্যান্সারে মানুষের মৃত্যু ঘটে।  সব েচেয়ে ঝুঁকিতে  থাকে প্রতিটি শিশু। তাদের কাছে কেহ ধুমপান করলে সেই শিশু আক্রান্ত হয় ভীষণ ভাবে। তাই আসুন  মৃত্যুদুত এই ধুমপানকে পরিহার করি।

াাতামাক চাষের পরিবর্তে ক্ষেতে এখন শীতকালীন সবজী ও ফসল এবং প্রচুর পরিমানে বাদাম চাষ হচ্ছে। হচ্ছে আলু , পটল, বেগুন , কলাই, মূলা ধনে, লাপা শাক, লাউ ,পিঁয়াজ রসূণ সহ অসংখ্য ফসল। ক্ষেত থেকে তুলে আনা হচ্ছে একদম টাটকা তরিতরকারি।। ভেজালের কোন ছোঁয়া নেই।
আমণ ধান উঠে গেছে। চলছে বোর ধানের প্রস্তুতি। সরিষা হবে তারপর। মোট কথা আবাদের ধরনও পাল্টে গেছে। সেই সংগে আবাদের প্রকৃতিও। সেকেলে পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক হয়েছে কৃষি ব্যবস্থা। আবাদে বৈজ্ঞানিক ছোঁয়াও লেগেছে ব্যপকভাবে। চাষাবাদ পদ্ধতিও হয়েছে উন্নত। কৃষি উপকরণ আর সেকেলে নেই। কলের লাঙ্গলে চাষ হচ্ছে। ধান কাটা ,ধান মাড়াই, ধান ভাঙ্গানো সবই এখন যন্ত্রের দ্বারা হয়ে থাকে। কিষাণীরা অতি ভোরে উঠে উড়োন-গাইন দিয়ে এখন আর ধান বানে না। গান গায় না- ও ধান বানং রে উড়ুন গাইন দিয়া। চলবে-

বাংলাদেশ সময়: ২০:০৩:৪৮ ● ৮১৪ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ