সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » বিবিধ » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৬: স্বপন চক্রবর্তী
সোমবার ● ২৩ মে ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ:  ( গত নভেম্বর’২১ এর শেষ সপ্তাহে হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া সীমান্তে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার উপর কিছু লিখার জন্য অনুরোধও ছিল। তাই বসে বসে সময় ক্ষেপন করেছি মাত্র। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হেতু সন্নিবেশিত ভুল তথ্যগুলো শুধরে দিলে উপকৃত হবো )।
আমার স্কুল জীবন ও কলেজ জীবন কেটেছে হাতীবান্ধায়। এ সম্পর্কে অন্যত্র লিখার আমার ইচ্ছা ছিল । সময় পেলে লিখতে ইচ্ছে রাখি। তবে কিছুটা না লিখলে প্রাসঙ্গিক হয়তো হবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে-পরে বেশ কয়েটি বছর আমি কাটিয়েছি দঃ গোতামারী গ্রামে। এটি হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত । লালমনিরহাট তখনও জেলা হয়নি, ছিল রংপরের একটি সাব-ডিভিশন। পরে ১৯৮৪ সালে এটিকে জেলা করা হয়। গোতামারী হলো সীমান্ত সংলগ্ন একটি গ্রাম। গ্রামটির উত্তর ও দক্ষিণ গোতামারী মিলে একটি ইউনিয়ন। নাম গোতামারী ইউনিয়ন। দইখাওয়া নামক একটি বাজার রয়েছে সেখানে। এই বাজারই ছিল সকলের মিলন মেলা। ইউনিয়ন পরিষদটিও সেখানেই অবস্থিত।
এবার প্রায় পাঁচ দশক পর সেখানে গিয়ে সব কিছুই অপরিচিত দেখলাম। সেই কাঁচা রাস্তা এখন আর কাঁচা নেই। আঁকাবাঁকা খানাখন্ধে ভরা রাস্তা এখন পাকা। দুএকটি রাস্তার পরিবর্তে রাস্তা হয়েছে অসংখ্য। যে রাস্তায় গরুর গাড়ী ছিল একমাত্র যানবাহন ,সেখানে এখন তার লেশ মাত্র নেই। একদা দেখেছি রাতের নীরবতাকে ভেদ করে গরুর গাড়ি ক্যাঁ ক্যুঁ শব্দ করে চলছে। একটি মৃদু আলো জ্বালা হারিকেন সামনে ঝুলছে। চাকায় কোন ধরনের লুব্রিকেন্ট প্রায় ব্যবহার করতো না বলেই হয়তো ভীষণ শব্দে গরুর গাড়ি চলতো। দিনে ও রাতে সমান ভাবেই চলতো গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ীতে করে নব বধূসহ অনেকে যাতায়াত করতো। মালামাল পরিবহনের জন্যও অবলম্বন ছিলএকমাত্র এই গরুর গাড়ি। অবস্থাপন্ন কোন ব্যক্তি কোথাও যেতে চাইলে আগেই হাকডাক করে বলে দিতেন গরুর গাড়ি বের করতে। তাদের বাড়িতে থাকতো গরুর গাড়ি। সুন্দর সাজানো গরুর গাড়ি একটা আভিজাত্যেরও বিষয় ছিল। যদিও অনেক অবস্থাপন্ন লোকও হাটে যেতেন খালি গায়ে বা ঘাড়ে জামাটি ফেলে। বিবাহের বর যাত্রী যেতো বেশ কয়েকটি গরুর গাড়ি একত্রে নিয়ে। গরুর গাড়ির ভিতরে বিছানো থাকতো পাটি বা মাদুর। একটিতে বর বসে থাকতো কিছু বন্ধু এবং দাদু এমন সম্পর্কীয় ব্যাক্তি নিয়ে । মহিলারাও সহযাত্রী হতো। তারা বরযাত্রী হিসাবে কনের বাড়িতে সমাদৃত হতো। কোন কোন গরুর গাড়িতে মাইক লাগানো থাকতো- আর মাইকে চলতো বিভিন্ন ধরনের বিয়ের গান। এর মধ্যে ভাওয়াইয়া গান থাকতো বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে। আবার কনে নিয়ে বিবাহের পর বর ফিরে আসতো। তখন বরের গাড়িতে একজন দুজন লোককে নেমে কনের জন্য জায়গা করে দিতে হতো। কনের সাথে শুধু কনেই গাড়িতে আসতো না- লোক একটু বেশী হয়ে যেতো। কারণ কনের একজন দিদিমা অথবা ঠাকুমা সম্পর্কের একজন বা একাধিক জন এবং ছোট শালী বা শ্যালক আসতো সাথে। এই দিদিমা সম্পর্কীয় ব্যক্তিটি বাসর রাত পর্যন্ত কনেকে অনেক উপদেশ দিয়ে তাকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত রাখতো। আমার মনে হয় আগে কিছুটা অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ হতো বলে এমনটি করা হতো। তবে প্রথা অনুসারে এখনও এই পদ্ধতির কিছুটা চালু রেখেছে। এই কনের সহযাত্রীগন কনে যাত্রী হিসাবে গন্য হতো। আহুত আত্মীয় সজনের মধ্যে কতজন কন্যা যাত্রী এসেছে তাও আলোচনা হতো। লোক সাথে না আসলেও অনেকে সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না। বর যাত্রীদের অবশ্য একটু বেশীই সম্মান দেওয়া হতো। বরযাত্রীদের কেহ কেহ কনের বাড়ির বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি খোঁজে বেড়াতো। এই সব বিষয়ে আগেই কনের পিতা অনুনয় বিনয় করে লোকজন সীমিত করে নিয়ে যেতে অনুরোধ জানাতো। বরপক্ষ অনেক সময় আত্মমর্যাদার ঘাটতি হলো কিনা এমন চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো।

সংগৃহীত ছবি: গরুর গাড়ির বহর

ছেলে পক্ষের অভিভাবক ব্যক্তিগত ভাবে বর যাত্রীদের খোঁজখবর নিতো্, নিজে খাবার গ্রহন করতো সবার পরে। অর্থাৎ অতিথি আপ্যায়নে তাদের ছিল বিশেষ বিনয়। তারপরও বরের সাথে কিছু বর্বরও সহযাত্রী হতো। অহেতুক কোন অমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি অঘটন বাধিয়ে বসতো। এই পরিস্থিতি সর্বত্রই কম বেশী ঘটে যায়। ফলে বরযাত্রীদের তেমন কিছু যায় আসে না। নতুন আত্মীয়দের মাঝে তিক্ততা বিরাজ করে দীর্ঘ দিন। এমন কয়েকটি বিয়েতে আমিও বরযাত্রী গিয়েছি। আমার বদভ্যাস মোতাবেক দু;একটি বিয়েতে মানপত্রও লিখেছি- যদিও সেগুলো কোন উন্নত মানের লিখা ছিল না।

এমনই একটি বিয়েতে আমাকে যেতে হয়েছিল। জনাব আনছার আলী মিয়া ( প্রাক্তন চেয়াম্যন ) বিবাহ করবেন গেন্দুগুড়ি গ্রামে। ওনার পছন্দের পাত্রী জাহানারা বেগম। আমাকে যেতে হবে বরযাত্রী হয়ে। আমার সহপাঠি লাইলী এসে নির্দেশের সুরে জানালো যে,আমাকে তর সঙ্গে একই গাড়িতে যেতে হবে। পরামর্শ মতো তাই করতে হলো। রাতে গরুর গাড়িতে রওয়ানা হলাম। আনুমানিক রাত প্রায় ৯ টায় কনের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। আদর আপ্যায়ণ ভালোই হলো। বিবাহ চলছে। লাইলী এসে আমাকে আবার জানালো তার সাথে যেতে হবে। কোথায় ? আমার সাথে। তাই করলাম। একটু বাঁশ ঝাড়ের নিচে রাখা গরুর গাড়িতে গিয়ে সে গাড়িতে বিছানো মাদুর উঠিয়ে খড়ের নিচে একটি কাঁসার সুন্দর থালা রাখতে রাখতে বললো,খেয়াল রাখবেন। আমিতো হতবাক,কোন জবাব দিলাম না। সে বললো,বিয়ে বাড়িতে চুরি করতে হয়। আজও আমি ব্যপারটি ভাবি। আনছার ভাই মারা গিয়েছেন। কিন্তু ভাবি জাহানারা বেগমের সাথে দেখা করে এসেছি।

এখন আর বিয়েতে গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হয়না। বিয়ে হয় বাস মিনিবাস রিজার্ভ করে। এবার গরুর গাড়ির কোন চিন্হ চোখে পড়েনি। বরং প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এক বা একাধিক মোটর সাইকেল দেখা গেছে। মাঠ থেকে অনেকের ধান-পাট ইত্যাদি ফসল আনা হয় ট্রাক্টরে করে, যা আগে দেখেছি গরুর গাড়িতে করে নিয়ে আসতে। বরং লোকজন এখন যাতায়াত করে অটো, টেম্পু, সিএনজি, বাস বা টটোতে করে। আমিও কৌতুহল বসত এই গাড়ির চালক হবার চেষ্টা করেছি। সফলও হয়েছি। তবে কঠোর সাধনায় অর্জিত এই বিদ্যা আর কোন দিন হয়তো কাজে আসবে না। না আসুক। এই গরুর গাড়ির সুবিধাগুলোর কথা যদি একটু বলি তাহলে বলতে হয় এর তেমন কোন অসুবিধা নেই। শুধু সুবিধা আর সুবিধা। কোন ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়না। গরু গুলো শুধু রংপুরের স্থানীয় ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় নির্দেশ দিলে একটু কম গ্রাহ্য করে। এই একটু সমস্যা। এই যানটি মন্থর গতির, তবে কোন মিডিয়ায় কোন দিন এর দুর্ঘটনার সংবাদ প্রচার করতে শোনিনি । আমিও কোথাও কোন দুর্ঘটনা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একদম নিরাপদ একটি যান। কোন হেলমেট লাগে না। চাকা পাংচার হয়না, টায়ার টিউবের কোন প্রয়োজন নেই। আজ অবলুপ্তির পথে এই গাড়িটি। এক সময় হয়তো যাদু ঘরেই কেবল প্রদর্শনীর বিনিময়ে এটিকে দেখা যাবে।

উত্তর বঙ্গ এক সময় দারিদ্র পীড়িত এলাকা ছিল। অবস্থাপন্নও যেমন ছিল তেমনি দুরাবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সংখ্যাও কম ছিল না। তুলনা মূলক ভাবে দরিদ্র পরিপারের সংখ্যাই হয়তো অনেক বেশী ছিল। শিক্ষার হারও ছিল খুব কম। সারা বাংলাদেশ যখন স্যানিটেশন ব্যবস্থায় ছিল অনুন্নত , তখন উত্তর বঙ্গ ছিল আরও বেশী পিছিয়ে। বিভিন্ন এনজিও গুলো জীবন যাপনের মান উন্নত করতে এগিয়ে আসে। হাতীবান্ধা সদরে RDRS সহ আরও কিছু এনজিও অফিস কাজ শুরু করে। পরে একে একে আরও এনজিও অফিস স্থাপিত হয়। একসময় শ্রমজীবি মানুষের কোন অভাব হতো না সেখানে। দিন আনতে দিন খাওয়া অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশী হওয়ায় তাদের ভিতরে সরলতাও ছিল খুব। মানুষকে ঠকানো বা প্রতারণা মূলক কাজ তাদের দ্বারা সংগঠিত হতো কম। মঙ্গা হলো তাদের এলাকার একটি বহুল পরিচিত নাম। মঙ্গা (আকাল) ছিল অভিশাপ। এই “মঙ্গা” তাদেরকে খুব দুর্বল করে দিতো এক সময়। এটা ছিল প্রতি বছরের একটা দুর্ভোগের নাম । বিশেষ করে আশ্বিন-কার্তিক মাস তাদেরকে খুবই নাজুক করে দিতো। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসেও মঙ্গা দেখা দিতো তবে তুলনা মূলক কম। এখনও হয়, তবে একবারে অনুল্লেখ যোগ্য। এক ফসলী বা দুফসলী জমিগুলো কৃষি ব্যবস্থার বহুমুখি প্রক্রিয়া করণের ফলে এবং উন্নত মানের বীজ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি আর সার সরবরাহ ও যন্ত্র দ্বারা সেচের ব্যবস্থার আধুনিক আবাদ পদ্ধতি অনুসরণের জন্য এই অভাব অনেকাংশে কেটে গেছে। এখন উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে নিলফামারীতে কিছু শিল্প কারখানা হয়েছে। রপ্তানী প্রসেসিং জোন হয়েছে।  জিডিপি  জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটা প্রভাব তো দেশের সর্বত্র আছেই, একে তো অস্বীকার করা যায় না।  এ সবের  কারণে আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা আর ব্যাপক ভাবে হানা দেয় না। গৃহকর্মী এক সময়ে সেখানে অনায়াসে পাওয়া যেতো এখন সেটা কল্পনা করা যায় না। মহিলারাও চাকুরি করছে শিল্প কাখানায় বা গার্মেন্টসে। বিধবাদের রয়েছে বিধবা ভাতা। বেকার বা স্বামী পরিত্যক্তাদেরও ভাতার ব্যবস্থা আছে, আছে ছাত্রী বৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা এইরূপ আরও কত কি।  চলবে-

বাংলাদেশ সময়: ২০:০৮:২০ ● ৮৯২ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ