বিপর্যস্ত অনুভব
Home Page » সাহিত্য » বিপর্যস্ত অনুভববিপর্যস্ত অনুভব
রোকসানা লেইস
কালঘুম থেকে জেগে উঠে দেখল সব ফাঁকা, চারপাশ শূন্য। আবীর রাঙা আকাশ, নীচু হয়ে যেন গিলে খেতে আসছে। হাত-পা-শরীর অবশ, নড়নের শক্তি নাই। চক্ষু দুটি খোলা শুধু আকাশের পানে। চোখ ছাড়া যেন সব মরে গেছে। ধীরে ধীরে কয়েকটা লম্বা শ্বাস নেয় ভেতরটা যেন নড়ে উঠে একটুখানি। হাতটা তুলে আস্তে আস্তে। অনেক কষ্ট হয়। ফর্সা সুডৌল বাহু কালসিটে রক্তজমাট, কাদালেপা চিত্র আঁকা। দু’হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুলে জড়িয়ে মাথার উপর হাত দুটো তুলে আড়মোড়া ভাঙতে চায়, চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ সময় লাগে, একসময় সমর্থ হয় আড়মোড়া ভাঙার, নড়ে উঠে ভেতর থেকে শরীর ব্যথায়। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে। কোমরের নীচ থেকে যেন নিঃস্বাড় হয়ে গেছে। আরো ধীরে আরো সময় নিয়ে উঠে বসে একসময়। মাটির ভিতর গেঁথে যাওয়া অর্ধেক শরীর টেনে। লোহুর ধারায় ভিজে গেছে মাটি। রক্ত জমে তামার মতন কালো হয়ে গেছে জমিন। ফর্সা পা দুটোর অবস্থা হাতের চেয়েও খারাপ। আকাশের রঙিন আলো কালো মেঘে ঢেকে যেতে থাকে।
কোনো কাপড় নাই গতরে। এইহানে এই উলঙ্গ অবস্থায় ঘুমাইয়াছিলাম কেন? রোজ কেয়ামত হইয়া গেছেনি?
─আশেপাশে তাকায়, কোথাও কেউ নাই। বামপাশে চোখ যায়। গর্ত মতন জায়গায় লাশের উপর লাশ। এতক্ষণে নাকে লাগে পচা বিশ্রী গন্ধ। ইন্দ্রিয়গুলো জাগছে আস্তে আস্তে। শরীরের নখ, দাঁতে কাটা চামড়ার ছিলা জায়গাগুলো জ্বলে জ্বলে উঠছে। ঘাড়, বুক, ঠোঁট, তলপেট সব ভারি, মোচড় দিয়া উঠে ঈশাণ কোণের কালবৈশাখী ঝড়ের মতন মাথার মাঝে ঝড়। ওরে আল্লারে… এক চিৎকার দিয়া..উ..উ..উ বিলাপ করতে থাকে। খানিক পরে নিজেই মাটি, রক্তমাখা আঙ্গুল মুখে চাইপা নিজের কান্দন থামায়। ভয়ে শিউরে উঠে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেউ নি আছে। দুশমনের দুশমন হারামীর বাচ্চা সব ছারখার করছে। শেষ কইরা দিছে এক্কেবারে। মনে পড়তে থাকে, আল্লার গজব না, ঝড় তুফান না, কেয়ামত না। হারামীর বাচ্চা মানুষ, ভিনদেশী মানুষ। বন্দুক লইয়া, আগুন জ্বালাইয়া, বুটে লাত্থি মাইরা, খুঁচাইয়া খুঁচাইয়া মানুষ মারতাছে পাখির লাহান। আর…আর কুলসুম বিবির মতন তরতাজা মাইয়াদের জ্যান্ত খাইয়া ফালাইতাছে। যেমনে পারে তেমনে যত জনে পারে ততজনে। জানোয়ারের অধম ব্যবহার। কামড়াইয়া খামচাইয়া, দাঁত বসাইয়া শরীলটারে খাইয়া ফালাইছে। একতিল শক্তি নাই। কেউ কি বাঁইচা আছে? একজন মানুষও? এত বড় গাঁওয়ের একজন মানুষও নাই? কোনো খানে কোনো সাড়া-শব্দ নাই। আমি কেন বাঁচলাম? এই পোড়া কপাল লইয়া কই যামু এখন? ধীরে ধীরে চিন্তাশক্তি কাজ করে আর শরীরের কষ্ট বাড়ে অসহ্য রকম।
মনে হইতে থাকে ভাত খাইয়া পান মুখে দিয়া ফুলির বাপের লগে বিছানায় গেছিল। পান খাইয়া রঙ্গ-তামাশা করতাছিল ফুলির বাপ। মানুষটার বড়ই রসের শরীল। তামাসা, ফুর্তি ছাড়া থাকতে পারে না একদম। কখনো মন খারাপ করে না। রাগারাগি করে না আর বউ-ঝি গো সোয়ামীর মতন। পান-খাওয়া লাল ঠোঁটে হাসি লাইগা থাকে মানুষটার।
─ কয়দিন ধইরা শুনতাছি, দেশের অবস্থা ভালা না, শহর থাইক্কা মানুষ আইতাছে এই গাঁওয়ে আর এই গাঁওয়ের মানুষ যাইতাছে আরো কুনোহানে, এমন বিপদ মাইনষের, তোমার হাসি তো থামে না ফুলির বাপ? আমাগো কোনো বিপদ হইব না তো ফুলির বাপ?
─ মুখ কালা কইরা থাকলে কি যমে আইব না, আগে এই শোলক ভাঙ্গাও। তার বাদে হাসি থামামু।
কথা ঠিক। কি আর কইব কুলসুম, লগে লগে হাসে।
হাসো হাসো, মরতে হইলে হাসতে হাসতেই মরমুনে। কে জানত মরণ খাঁড়াইয়া আছিল, দরজার বাইরে হেই সময়।
ফুলি ঘুমাইয়া ছিল দাদীর গলা জড়াইয়া ডানপাশের ভিটার ঘরে। ঘুমাইতে যাওনের আগে কইতাছিল, আইজ দাদীর লগে ঘুমামু, কাইল তোমার লগে ঘুমামু মা।
একলা বিছানায় তাই কুলসুমরে বুকে জাপটাইয়া ধরতে এত্তটুকু বাধা আছিল না। পুরুষালী শইলের গন্ধে উথাল-পাথাল কুলসুমও লোমশ বুকে মুখ ঘষতাছিল আরামে। জৈষ্ঠ্যি মাসের মাঝামাঝি সময় আম-কাঁঠালের পাকা গন্ধে ভুরভুর আর গরম ঘরে আরো গরমে মাখামাখি দুই জোয়ান শরীল ঘামে ভিইজ্যা দক্ষিণের ছোট্ট খিরকীর খানিক বাতাসে অবসন্ন হইয়া ঘুমাইয়া পড়ছিল আরামে। হঠাৎ খিরকীর ছরকাকাটা বেড়াখান উইড়া আইসা পড়ল দুইজনের উপর, সাথে অজানা ভাষার চিৎকারে কাঁইপ্পা উঠল বুকের ভিতর। থরথর কাঁপছে কুলসুম সোয়ামিরে জড়াইয়া ধইরা। লাত্থি দিয়া দরজা ভাইঙ্গা ঘরে ঢুইকা পড়ছে বেগানা পুরুষ একজন না, কয়েকজন। শরীলে কাপড় দেয়ারও সময় হইল না। পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো সরাসরি কুলসুম বিবির মুখে, সেখান থেকে ঘুরে ঘুরে সারা শরীলে পড়ল টর্চলাইটের আলো। একজন আইসা টান মাইরা লইয়া গেল ফুলির বাপরে কুলসুম বিবির দুই হাতের আগল ছুটাইয়া ঘরের বাইরে। না…আ … আ কইরা এট্টা চিক্কুরই শুধু দিতে পারছিল আর সেই চিক্কুরের সাথে মিইলা গেছিল বাইরে গুলির আওয়াজ। ডানের ভিটায় ফুলি আর ফুলির দাদীর খবর কিছুই জানে না কুলসুম বিবি। খালি মনে আছে, ওর উদাম শরীর টাইনা হ্যাঁচড়াইয়া একখান গাড়ির ভিতর ফ্যালাইয়া লইয়া গেছিল ইস্কুল ঘরে। ওই লইয়া যাওনের সময় দেখছিল উঠানের মাঝে চিৎ হইয়া পইড়া রইছে ফুলির বাপ, উঠান ভাইসা যায় লোহুর ধারায়। কুলসুম বিবির বুকের সুখগুলান বানের পানির লাহান ভাসাইয়া লইয়া যায় লোহুর ধারায়।
ঝকঝকা জৈষ্ঠ্যি মাসের ভরা পূর্ণিমার রাত সাদা দুধের লাহান সর পইড়া রইছে দুনিয়ায়। মনে হইতাছিল যেন বেহেস্তের বিচরায় বইসা আছিল যখন ফুলির বাপে হাসি-তামাশা করতে আছিল। দক্ষিণের খিরকীর ফুরফুরা বাতাস আর চান্দনী জীবনের সব-সুখ সব-আয়েস লইয়া আইছিল। ফুলির বাপ তুমি তো সুখ লইয়া হাসতে হাসতে চইলা গেলা। আমি কেন গেলাম না তোমার লগে? এত আজাবের বাদেও কেমতে আমার মরণ হইল না? ফুলি আমার জান কলিজা, মাগো তুই কই ? দাদীর লগে আছনি? আম্মা, আমার ফুলিরে দেইখা রাইখেন, আম্মাগো। বুক মুচড়াইয়া ফুঁপাইয়া উঠে কুলসুম বিবি আবার। বুক ফাইটা যায়, চোখে পানি আসে না। শব্দ করতে পারে না।
চারপাশে ঘাড় ঘুরাইয়া কুলসুম বিবি চিনতে চায় কোথায় আছে? গাঁওয়ের কোনো সীমানা এইডা? এমন অচেনা মনে হয়। ঘাড় ঘুরাইতে, হাত নড়াইতে জানটা বাইর হইয়া যাইতে চায়।
শরীরে যেন শিকড় গজাইয়া গেছে মাটির মাঝে।
অনেকক্ষণ চেষ্টা কইরাও উঠতে পারে না কুলসুম বিবি। গড়ান দিয়া আবার পইড়া যায় মাটির মাঝে। দেখে রাঙ্গা আসমান আন্ধার হইয়া গেছে। কালামেঘ ভিড় করতাছে হেইখানে। নিথর নীরব দুনিয়া একটা পোকারও শব্দ নাই কুনোহানে।
শরীর, স্নায়ু, মুখ, তালু, জিহ্বা, গলা বুক শুকাইয়া কাঠ। থুতুও নাই একফোঁটা। পানি পানি পানি খামু। মাথার ভিতর এই কথা ঘুরে কুলসুম বিবির। প্রাণ আনচান, পানির তিষ্ঠায় বুক ফাটে কারবালার প্রান্তরে যেন পানির অভাবে মইরা যাইতাছে কুলসুম বিবি। গভীর অতলে ডুবতে থাকে চেতনা; মৃতদের ভিড়ে মৃতের মতোই পড়ে থাকে কুলসুম বিবি অচেতন।
ঝমঝম বৃষ্টি অঝরে ঝরছে, ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারপাশ। অচেতন কুলসুম বিবির চেতনা আসে আবার বৃষ্টির ধারায় ভিজতে ভিজতে। চোখ মেলে দেখে আকাশের কান্না। হাঁ করে মুখে নেয় বৃষ্টির পানি। ধুয়ে যায় শরীর অঝর ধারার বৃষ্টিতে।
আল্লাহ আসমান থাইকা পানি ঢালতাছে। কুলসুম বিবি ভাবে, আসমান যেন পয়স্বিনী। দুধের ধারায় গতর ধুয়ে দিতাছে, শইল্যের সকল ময়লা ধুইয়া লইয়া যাইতাছে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় কুলসুম বিবি। বহুত কষ্ট হয়। দুই ঊরুর মাঝে যেন আগুন জ্বলতাছে। লোহুর ধারায় ভাইসা গেছে পাও। বৃষ্টির পানিতে সাফ করে নিজেকে। আর পান করে বৃষ্টির পানি অঞ্জলি ভরে। হাঁটে কুলসুম বিবি, কোন দিকে যাবে কিছু জানে না। কোনো পথের দিশা নাই। শরীরে একখান কাপড় নাই। উলঙ্গ কুলসুম বিবি কোথায় যাবে, কতদূর কিছু জানা নাই। এই ধরণীর বুকে যেন সব মৃত। শুধু এক মানবী প্রকৃতির একটা অংশ হয়ে হাঁটে অন্ধকারে ফিকে ধূসর আলোয় ধীরে ধীরে। বৃষ্টি ধরে আসে, স্থির হয়ে থমকে যায় যেন শূন্য চরাচর পৃথিবী। শুধু হেঁটে চলে কুলসুম বিবি আর আকাশে কালো মেঘ উড়ে যায়। একসময় কালো মেঘের ফাঁকে উঁকি দেয় ভাঙা চাঁদ।
(আলোর যাত্রা উপন্যাসের অংশবিশেষ)
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৩৬:০৫ ৫৬১ বার পঠিত
সাহিত্য’র আরও খবর
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]