রুগ্ন এক শহরে- মোহাম্মদ দিদার হোসাইন

Home Page » ফিচার » রুগ্ন এক শহরে- মোহাম্মদ দিদার হোসাইন
সোমবার, ৩০ মার্চ ২০২০



২০০বছর আগের ঢাকার অংশ বিশেষ

গত শতাব্দীর নব্বই দশকের পর ক্রমশঃ স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে চরম খামখেয়ালীপনা আর উন্মাদনায় স্ফীত হয়েছে আমাদের শহর ঢাকা। আজকের ঢাকার বিস্তৃতি পঁচা ও দুর্গন্ধময় বুড়িগঙ্গা নদী হতে সমজাতীয় তুরাগ তীরে গিয়ে ঠেকেছে। মধ্যবর্তী জটিল ও কুটিল মানচিত্র বহুবিধ বৈচিত্র্য, বৈষম্য, ঝুঁকি, পুঁজি, অনটন, বিলাসিতা, শ্রম, মুনাফা, শোষণ, শিক্ষা, অজ্ঞতা, সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি, প্রশাসন, প্রটেকশন, অপরাধ, আলো, অন্ধকার এবং ঘোর লাগা আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল। দেশের মফস্বল থেকে ঢাকায় আসার দুর্নিবার আকর্ষণ সত্তর/আশির দশকের বাংলা ছায়াছবির হারানো দিনের গানে এখনো সংরক্ষিত “ঢাকার শহর আইস্যা আমার আশা পুরাইছে”।

ফাইল ছবি

হাট জমতে অবশ্য বেশি দিন লাগেনি, মাত্র ২/৩ দশকে ঢাকা পরিণত হয়েছে কানার হাট-বাজারে! ফল হয়েছে অত্যন্ত করুণ- ঢাকা পরিণত হয়েছে নিম্নমানের পয়ঃ নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে মল-মুত্র আর ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে, নালা-জলাহীন জলাবদ্ধ ঢাকায়, সীসা দূষণে দূষিত এবং জানজটে নিশ্চল শহরে। গত দুই দশকে নিয়মিত বিরতিতে ঢাকার মহামারী হিসেবে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল মশক বাহিত ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া। ওয়াসার দূষিত পানি, জলাবদ্ধতার নোংরা পানি কিংবা প্রচন্ড তাপদাহ কখনো কখনো এই নগরীতে কলেরা বা ডায়েরিয়া আতন্ক ছড়েয়েছে। দূষিত ঢাকার জল-হাওয়া বিশুদ্ধ করা কিংবা সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য পরিবেশ আন্দোলন, ঢাকা বাঁচাও আন্দোলন আরো আরো কত আন্দোলন হলো! এন.জি.ও. তৎপর হলো, কর্পোরেশনের পরিকাঠামো স্ফীত হলো, হাড়-ভাঙ্গা শ্রম আর সরকারি -বেসরকারি বিনিয়োগেও শুদ্ধ হলো না ঢাকা। জিগির উঠলো -চলো গ্রামে ফিরে যাই, কাজ হলো না। বিকেন্দ্রীকরণের পুরনো ফর্মুলা নতুন নতুন কর্ম-কৌশলে প্রয়োগ হলো, নগদ লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব বিবেচনায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মেয়াদী পরিকল্পনা ও ছক নিয়ে আমাদের নগরবিদদের গবেষণার ভলিউম যখন হস্তির ন্যায় স্থূলকায় হলো আর পলিসি-ডায়লগের মঞ্চ, টি.ভি. দেখে আমরা যখন ক্লান্ত প্রায় তখন-ই আবির্ভূত হলো করোনা-জী। ভাইরাস মহামারীর প্রবল আতন্ক প্রথমবারের মতো দেখা দিল ঢাকার বুকে, অবশ্য এ আতন্ক শুধু ঢাকাকেই নয় সমগ্র বিশ্বকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে একসাথে। এই প্রথম ঢাকা তথা গোটা বাংলাদেশ কোন বৈশ্বিক সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিণত হলো! অথচ এই ভাইরাসের জন্ম কিংবা ছড়িয়ে পড়া কোনটাই এই শহর বা দেশ থেকে সূচিত নয়। বিশ্বায়নের কুপ্রভাবে আগন্তুক ভিনদেশী এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বিদেশগামী প্রবাসীদের পোষকে এ বিপজ্জনক ভাইরাসটির আগমন ঘটেছে আমাদের দেশে। COVID-19 নামক এই ভাইরাসের ম্যাজিকেল একশনের পরিণতি হলো সবচে’ রুগ্ন, শ্রান্ত, জন-কোলাহল শূণ্য আজকের ঢাকা। মেট্রোপলিটন শহর থেকে কস্ মোপলিটান শহরে পরিণত হওয়া ঢাকার জন্য এ যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা!

---

প্রায় হপ্তাখানেক ধরে ঢাকা যে রূপ-চেহারা ধারণ করেছে তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই শহরে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস। যে শহর ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই হাঁক-ডাকে জেগে ওঠে সেই শহর মধ্য দুপুরেও নীরব-নিথর। ঢাকার চিরচেনা রূপে মাঝে মাঝে ছন্দপতন হয় না তা নয়। ঈদে, রাজনীতিক গোলমালে কখনো সখনো ঢাকার ব্যস্ততায়, জনসমাগমে ভাটা পড়লেও কারো না কারো দখলে ছিল রাজপথ, অলি-গলি, পার্ক-উদ্যান, বিনোদন কেন্দ্র, হল-থিয়েটার, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, চার্চ। নগরীর অনিবার্য জন সমাগমের সকল স্থানগুলোতে আজ কল্পনাতীত জনজট শূণ্যতা। ভাইরাস আতন্ক সর্বকালের সকল ইতিহাস স্তব্ধ করেছে, যে নগর ছেড়ে যেতে চায় না একজন ভবঘুরেও সেই নগর ছেড়ে উন্মাদের মতো দৌড়ে পালিয়েছে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ। বাকি যারাও বা আছেন এই শহরে কোন না কোন কাজে কিংবা যারা বাধ্য হয়েছেন থাকতে তাদের প্রায় নব্বই শতাংশ গৃহবন্দিত্ব বরণ করেছেন বাঁচার তাগিদে। স্রেফ কপালদোষে রাস্তায় টহলে আর্মি-পুলিশ, জরুরি দায়িত্বে নিয়োজিত সিভিল প্রশাসন, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার-নার্স, এম্বুল্যান্স কর্মী, ব্যবসার মওকা লুফে নেয়া ওষুধ আর খাদ্য সামগ্রী বিক্রেতারা।

ফাইল ছবি

লোকচক্ষুর আড়ালে যে স্বল্প সংখ্যক লোক ভাইরাস আতন্ক জয় করে বীরদর্পে রাজত্ব করার জন্য আকুপাকু করছে তারা হলেন পেশাদার ছিনতাইকারী, ডাকাত, চোর, খুনি আর বেপরোয়া মাদকাসক্ত। এই দুর্দিনেও নগরীর কোর্টে মায়ের খুনি এক কুলাঙ্গার পুত্রের খুনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়! তাই গৃহত্যাগী ও গৃহবাসী ঢাকার নাগরিকদের রোগ-শোকের আতন্কের পাশাপাশি জান-মালের নিরাপত্তার শন্কাও কম নয়! আশা-নিরাশার সাইরেন বাজিয়ে এই রুগ্ন শহরের রাজপথে ছুটে চলে টহল জীপ আর এম্বুলেন্স। আমরা দিন গুনি, সাইরেনের শব্দ যেন প্রকট না হয়। যেমন ঢাকা দেখে আমরা গৃহবন্দিত্ব বরণ করেছি তেমন ঢাকাই যেন ফিরে পাই খুব শীঘ্রই, অন্ততঃ তার চেয়ে অবনতি না হোক ঢাকার নাগরিক ও নগর জীবনের।

দিদার হোসেন

লেখকঃ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা।

জাজে’স কোয়ার্টার,

আজিমপুর, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ৯:৩৪:৫০   ১৭৯২ বার পঠিত   #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ফিচার’র আরও খবর


অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে তৃতীয় বর্ষে রবিকর ফাউন্ডেশন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রক্ষায় প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির পর্যালোচনা
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
মোহাম্মদ শাহ আলমের জীবন ও কর্ম
ইসফাহান নেসফে জাহান
সিলেটে গ্রুপ ফেডারেশনের কর্মশালায় বির্তকিত মুরাদ- আয়োজকদের দুঃখ প্রকাশ
ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, টাকার দাম কেন কমছে

আর্কাইভ