নাসরিন রুনা’র লোড বিকাশের দোকানদার থেকে সোনালী ব্যাংক অফিসার হবার গল্প

Home Page » ফিচার » নাসরিন রুনা’র লোড বিকাশের দোকানদার থেকে সোনালী ব্যাংক অফিসার হবার গল্প
রবিবার, ৩১ মে ২০২০



নাসরিন রুনা

বঙ্গ-নিউজঃ   পরিচিত/অপরিচিত অনেকেই জানতে চেয়েছেন কিভাবে আমি পড়েছি বা কিভাবে আমি ১ম রিটেন ১ম ভাইভাতেই এই অবস্থান অর্জন করেছি।যারা আমাকে জানেন বা দেখেছেন তারা অনুধাবন করেছেন আমার স্ট্রাগলিং লাইফ।আজ আমার থেকে অনেক বেশি খুশি তারা হয়েছে যারা মন থেকে চেয়েছেন আমার সফলতা।

আমি মনে করি এই চাকরি আমার সফলতার ১ম সিঁড়ি। আমাকে যেতে হবে আরো অনেকটা পথ।তবে এটা সত্য যে আগামী তে যদি বিসিএস এর সর্বোচ্চ ক্যাডার ও হয়ে যাই তবুও এই খুশির কাছে ওটা অনেক কম হবে।

তবুও অনেকের অনুরোধ রক্ষার্থে আজ আমি আমার জীবনের কিছু কথা তুলে ধরব।এটা পড়ার পর যদি কোন হতাশাগ্রস্ত মানুষ নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায় তবেই আমার লেখাটা সার্থক।

 মেয়েবেলা এবং আর্থিক অবস্থা 
আমার আব্বু গাবতলিতে এক পরিবহনে কাজ করতেন।শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে ২য় শ্রেণী পাশ। তবুও প্রায় ২৮ বছর তিনি অভিজ্ঞতার জোরে ম্যানেজার পোস্টে ছিলেন।গাবতলি এমন এক জায়গা যেখানে ধোকা দিয়ে বা অসৎ উপায়ে অনেক টাকা আয় করা গেলেও আমার আব্বু একটু অন্যরকম।তিনি নিজের যেটুকু আছে তাই নিয়েই থাকা পছন্দ করতেন তাই অভাব ই বেশি লেগে থাকত।
আর গাড়ির লাইনে যাদের একটু ধারনা আছে তারা জানেন,গাড়ি চললে বেতন আছে নতুবা নাই।মানে একদিন হরতাল/কাজে গ্যাপ মানে সেদিনের টাকা নাই।আব্বুর কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বলে কিছু ছিলোনা।যা প্রতিদিন ইনকাম হতো তাই হিসেব করে আলাদা আলাদা করে জমাতেন।মাস শেষে সব বিল মেটাতেন।

ক্লাস সিক্স পর্যন্ত টিনশেড বাড়িতে থেকেছি।ছোটকাল থেকেই বলা যায় মেধাবী ছিলাম।রোল ১ম সারিতেই থাকতো।আব্বু আম্মুর স্বপ্ন তখন থেকেই যে আমাকে তারা অনেকদূর পড়াবেন। সিক্স এর মাঝামাঝি দিকে ২ রুমের ফ্লাটে উঠি যে বিল্ডিং এ আমাদের স্কুলের ই ৩ জন শিক্ষক থাকেন এবং সরকারী কর্মকর্তা থাকেন।তাদের অনুযায়ী আমরা কিছুই না।আব্বু চেয়েছিলো আমাদের একটা ভালো পরিবেশে বড় করতে।
যত কষ্ট ই হোক আব্বু আমাদের ২ ভাই-বোনের পড়াশুনা নিয়ে কার্পণ্য করেন নি।
কয়েক বছরে কোন জামা-কাপড় না দিলেও বই-খাতা-কলম ভরপুর ছিলো।
তার একটাই কথা “পড়াশুনা করে যখন বড় অফিসার হবি তখন বিলাসিতা করিস।”

আশেপাশের সবাই যখন ভাল ড্রেস পরতো তখন আব্বুর উপর রাগ হতো,,এত কিপ্টা ক্যান,,রাগি ক্যান,,বাপ হইসে তো পোলাপান কে ক্যান দিতে পারে না ব্লা ব্লা ব্লা।

রোজার ঈদ আসলে বলতো,কোরবানীর ঈদে দেব,কোরবানি আসলে বলতো,রোজার ঈদ।এভাবেই আমাদের ২ ভাই-বোনের পুরোনো কাপড়েই ঈদ যেত।যেহেতু আশেপাশের সবাই যথেষ্ট ধনী সেখানে একটু লজ্জা ও পেতাম।

একবার খুব কান্নাকাটি করলাম যে ঘরে কি খেলাম না খেলাম কেও কি দেখে??জামাকাপড় টাই দেখে।এত ভাল-মন্দ খাবারের দরকার নাই।

আব্বুর সেদিনের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে।তিনি আমাকে বললেন,”শোন,পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে কারন তোকে অনেক পড়তে হবে আর পড়তে গেলে ভাল পুষ্টি দরকার।ভাল পোষাক পরে যদি অসুস্থ হয়ে যাস তবে লাভ কি? আর মানুষ কে বাইরের চাকচিক্য দেখিয়ে কোন লাভ নাই,ভেতর টা সুন্দর হলে ছেঁড়া পোষাকেও মানুষ তোকে ভালবাসবে”

এরপর আরেকদিন আমার আব্বু বললেন, ” কখনো উঁচু তলার মানুষ কি ড্রেস পরলো,কি স্টাইল করলো ওগুলা নিয়া ভেবে মন খারাপ করবিনা,নিজের যা আছে তাই নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলবি।
চিন্তা করে দেখ তো,তোর বাপ-মা বেঁচে আছে,ভাল বাসায় থাকতে পারছিস,ভাল জায়গায় পড়ছিস অথচ রেললাইন এর ধারে হাজার ও মানুষ আছে যারা ১ বেলাও ঠিকমত খেতে পারে না।আল্লাহ যদি এমন করতো তবে কি করতি??তার থেকে তো হাজার গুনে ভাল আছিস।”

 টিওশন এবং পড়ার পরিবেশ
নিরিবিলি পড়াশুনা করার মত পরিবেশ কখনোই আমার বাসায় ছিলো না।তার প্রধান কারন আমার বাসায় সবসময় ই কোন না কোন মেহমান থাকতোই।সেটা যেকোন কাজে,ডাক্তার দেখানো বা কোচিং করতে আসা বা চাকরির জন্য যাই হোক ঢাকায় আসা মানেই আমাদের বাসায় আসা।আমার এসএসসি এর সময় বাসায় ১৪+ মানুষ ছিলেন।আরো মজার ব্যাপার হলো লকডাউন হবার ২ দিন আগ পর্যন্ত ১বেলা মেহমান ছাড়া ভাত খেয়েছি কিনা বলতে পারবনা।আমার অনেক বন্ধুরা তামাশা করে বলতো,তোদের বাড়ি নাকি ফ্রি সরাইখানা?
.এটা নিয়ে কিছু বলার নাই কারন আমার আম্মু এতটাই ভাল মানুষ যে বোঝানো যাবেনা।আমি মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও মা বোঝাতেন এভাবে ” মানুষ বিপদে পরেই আসে,মানুষের উপকার করলে আল্লাহ খুশি হয়,মানুষের দোয়া বড় পাওয়া।সবার বাসায় মেহমান কি যায় নাকি?তোর বাসায় কেও পোলাও খাইতে আসে নাকি?ডালভাত এই তৃপ্তি,মেহমান হলো রহমত।আল্লাহ খুশি হন।”
আমার নিরিবিলি পড়াশোনার জন্য রুম তো দূরে থাক আমি আজীবন মেঝেতেই ঘুমাইছি।পড়াশোনা অনেক কম করতাম তবে যেটুকু করতাম ভাল করে।

আমি ক্লাস এইট থেকে টিওশন করাই।প্রায় ১৬ বছর টিওশন করিয়ে ২০১৯ এর ডিসেম্বর এ সব বাদ দিয়ে চাকরির পড়া শুরু করি।গনিত+ইংরেজি পড়াতাম।এলাকায় ভাল টিওটর হিসেবে সুপরিচিত ছিলাম।আমি আমার টিওশন এর টাকা দিয়েই মোটামুটি নিজের খরচ চালাতাম।লাস্ট কবে আমা আব্বু আমাকে টাকা/ড্রেস দিয়েছেন আমার মনে নেই।

ভুল সিদ্ধান্ত এবং কিছু হতাশা 

জীবনে আমি একটাই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর হলো একজনের প্রেমে অন্ধ হয়ে বিবিএ তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ চান্স পেয়েও,ঢাকা ছেড়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ এ বিবিএ করা। এমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে।পরিবার কে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে চলে গেলাম যশোর।তারা আজ হয়তো জানবে যে পাবলিক এ চান্স পেয়ে আমি পড়িনি।পড়েছি ন্যাশনাল এ।
ঢাকা থেকে যশোরে কেন এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমি প্রতিনিয়ত হয়েছি আর আমি অবলীলাক্রমেই বলে দেই প্রেমের টানে গিয়েছি বাঁশঝাড়ে।

যাহোক,যশোর এ আমার দিন অনেক কষ্টে কেটেছে।বাপ/চাচারা ৩ বছর কোন কথা বলেন নি আমার সাথে।মাস শেষে মাত্র ৩০০০ টাকা আব্বু পাঠাতেন যেখানে ১১০০+১১০০=২২০০ আমার কলেজের বেতন আর ঘরভাড়াতেই যেত।
বাকি ৮০০ টাকায় কি আর বাজার বা অন্য খরচ হয়?ঢাকায় টিওশন এ যেমন টাকা পেতাম যশোর এর টিওশন পুরাই ছ্যাচড়ামি।৫০০/৭০০ এর উপর কেও টাকা দিত না।
তবুও কয়েকটা টিওশন করাতাম।এভাবে কোনরকম কষ্ট করে ৫ বছর কাটিয়ে ২০১৫ তে ঢাকায় চলে আসি।

আব্বুর চাকরি হারানো এবং
আমার দোকানদারি

২০১৫ তে ঢাকা এসেও টিওশন ধরি।আর এর আগে ২০১৪ এর দিকে এত পরিমান হরতাল/অবরোধ ছিলো যে ওই সময়ের কষ্টের কথা বর্ণণা করলে শেষ হবেনা।
২০১৬ এর প্রথম দিকে আমার আব্বুর চাকরি চলে যায়।অনেকটা রাগ করেই আব্বু ২য় বার ডাকা স্বত্তেও জয়েন করেনি।সে পাশের আরেকটা পরিবহনে আরো নিচু পোস্ট এ জয়েন করে।একে তার যা বয়স তার উপর এমন প্রেশার এ ওই কাজ করাটা ঠিক ও না।

এদিকে বলা ভালো,আমাদের এত কষ্টের মাঝেও আমাকে বিসিআইসি কলেজ ও আমার ভাই কে ঢাকা কমার্স কলেজে পড়িয়েছেন যেখানের বেতন অনেক বেশি।

আমার ছোট ভাইটাও অনেক স্ট্রাগল করেছে কারন ওই সময়ে ও একটা মোবাইল সার্ভিস এর দোকানে কাজ করে কিছু টাকা আয় করতো।

২০১৬ এর ১৬ ডিসেম্বর আমি আর আমার ভাই দোকান দিলাম। এই দোকান করতে পরিবার এর কেও ই সম্মতি দেয় নি।এমনকি আমার আব্বু ও না।কারন আজীবনের স্বপ্ন আমাকে সরকারী চাকুরী জীবি দেখবে।সেখানে এখন দোকান তাও লোড বিকাশের..

আত্নীয়রাও এটা মানলেন না।এত পড়াশুনা করে শেষে নাকি এই কাজ? ছিঃ পরিচয় দেয়া যায় নাকি?

মাত্র ৬০০০০ টাকা নিয়ে আমি আর আমার ভাই দোকান দেই।টাকা সব ধার করা।আমার ও রানা(আমার ভাই) এর কিছু বন্ধু /পরিচিত রা ধার দিয়েছিলেন।দোকান এর মালিক অনেক ভাল।অ্যাডভান্স এর টাকাও নেননি আমাদের উপর মায়া করে।

মাত্র একটা টেবিল আর ২ টা চেয়ার দিয়ে দোকানের যাত্রা শুরু।তখন আমার ভাই প্রাইম ইউনিভার্সিটি তে বিবিএ করে।ওর সপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস আর আমার ক্লাস ২ দিন জাহাঙ্গীরনগরে (শুক্র+শনি)।

৩ বছর ১ সেকেন্ড ও হয়তো রেস্ট নেইনি।সকাল থেকে দুপুর আমি বসতাম।রানা ভার্সিটি থেকে এসে গোসল+খাওয়া শেষে টানা রাত ৯ টা পর্যন্ত বসতো,আমি তখন ৬ জন স্টুডেন্ট পড়াতাম বিকাল ৩ টা থেকে রাত সাড়ে ৯ টা বেজে যেত।একেকজন এর বাসা ৪/৬ তলায় ছিলো।
টিওশন থেকে এসে বাসায় ব্যাগ রেখে,নামাজ পড়েই আবার দোকানে বসতাম।তখন রানা মোবাইল সার্ভিসের কাজ করতো।এভাবে প্রায় ই ১১ বাজে ঘরে ঢুকতাম।
আর শুক্র শনি সারাদিন আমি জাবিতে থাকতাম।রানা একা কষ্ট করতো।
দোকান দেবার পর আব্বু ভেবেছিলো টিকবেনা।কয়দিনেই হয়তো শখ পূরন হবে।কিন্তু রানা আর আমার নিরলস পরিশ্রম এ এলাকায় সবাই খুব পছন্দ করলেন।
আব্বুকে ওই পরিবহনের চাকরি ছাড়িয়ে দোকানের লোড/বিকাশ দেয়া শেখাতে থাকলাম।আব্বু হয়তো পড়াশোনা কম জানেন তবে মেধা অনেক ভাল।।কম সময়েই শিখে নিলেন।।এর মাঝে আমার একটু ভাল হল।

২০১৮ এর ২১ জানুয়ারি আমি বাসায় আসি আর রানাও বাইরে।এই সুযোগে আব্বুকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে ৩ জন প্রায় ৯৬০০০ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।এটা অনেক বড় ধরনের ধাক্কা ছিলো।কিন্তু হতাস হইনি আমরা।আবার শুরু করি পথচলা।

দোকানের শক্তি আমার ভাই।আমি শুধু একটু সাপোর্ট দিয়েছি।এখন মিরপুর ১ এ আমাদের দোকান সেরা ১০ এ আছে।আর এটা সম্ভব হয়েছে আমার ভাই আর আমার নিষ্ঠার মাধ্যমে কাজ করাতে।

মানুষের কথা এবং

আমার ডোন্ট কেয়ার ভাব

মানুষ আপনাকে কথা না শোনালে আপনি কখনোই উপরে উঠতে পারবেন না।তবে সেসব কথা শুনে যদি হতাসায় ভোগেন তবে আপনি শেষ।আমি ছোটকাল থেকেই অন্যদের তুলনায় একটু আলাদা।কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না,আমি যা করছি তা সঠিক কিনা এটাই মূখ্য।
যেকোন কিছু আমি চেষ্টা করতে পছন্দ করি।কারন আমি বিশ্বাস করি “কোন কাজ না পারাটা পাপ নয়,চেষ্টা না করাটাই বড় পাপ”

প্রথম দোকানে বসার পর আত্নীয়/পরিচিত এলাকাবাসীর উক্ত কিছুটা

ছিঃ ছিঃ মেয়ে মানুষ লোডের দোকানে?

জাহাঙ্গীরনগরে এমবিএ করে শেষে কিনা বিকাশের দোকানদার

মান-সম্মান থাকলো না, এই মেয়েকে কোন ভদ্র পরিবার বৌ হিসেবে নেবে?

দুনিয়া আর দুনিয়া নাই, এত পড়াশুনা করে শেষে কিনা লোডের দোকান

একটা এনজিও বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলেও তো ঢুকতে পারতা এই দোকনদারি সবাই ভালভাবে নেয় নাকি??এখন ও তো বিয়া করনাই।ভাল বিয়ের প্রস্তাব তো আসবেনা।

যাহোক এরকম হাজারখানেক কথা ২০১৬ থেকেই শুনে আসছি কিন্তু হাসিমুখে উড়িয়ে দিয়েছ।
কারন যাদের কাজ কথা শোনানো তারা আজীবন এটা করেই যাবে।আমর ঘরে যখন ১ কেজি চাল ছিলো না বা আমার আব্বুর যখন ২ মাস কাজ ছিলো নাতখন এরা তো খোঁজ নেয়নি যে খেয়েছি কিনা…
আর আমি যা করছি তা আমার ইচ্ছায়।
আমার ভাইটাও ছোট ছিল।আমি যদি এটুকু হেল্প না করতাম তবে আমার ভাইকে হয়তো পড়া বাদ দিতে হতো।যত কষ্ট ই হোক পড়া চালিয়ে যেতেই হবে।

এক্স্ট্রা কারিকুলাম
আমি ছোটকাল থেকেই এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি তে অংশগ্রহণ করতাম।জীবনে ইচ্ছা থাকলেও কোন কিছু না শিখেও নাচ/গান/আবৃত্তি /বিতর্ক /কুইজ/অভিনয়/স্কেচ/উপস্থাপনা সহ যা যা আছে সব কিছুতে জয়ী হবার পুরষ্কার রয়েছে।অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা খুব কম করতাম।পুরে বিবিএ শেষ করেছি কোন বই কিনিনি।পরীক্ষার ২ দিন আগে কোন রকম করো কাছ থেকে পড়ে পরীক্ষা দিতাম।

আমার টিচার রা আমাকে পছন্দ করতেন কারন আমি ক্লাসে মনোযোগী ছিলাম।
রোল ১ নাহলেও আজীবন ক্যাপ্টেন্সি করেছি।সব কিছুতে পারদর্শিতায়  অলরাউন্ডার এর পুরষ্কার ও পেয়েছি। তবে কোন সংগঠন এ জড়াতে পারিনি টাকার /সময়ের অভাবে।
বন্ধু দের সাথে কখনো ট্যুর এও যাইনি,অথচ ওদের বলতাম বাসা থেকে যেতে দেয় না।
আসল কথা হলো ঘোরাঘুরির টাকা নাই।

 চাকরির পড়াশুনা 

আমি যদি এখন বলি যে পড়াশুনাই করিনি তবে সবাই বলবেন,চাকরি হয়ে গেছে তাই ভাব নিচ্ছি

তবে এটা সত্যি যে টোটাল বই না ধরে প্রিলি তে টিকেছি।প্রিলির রেজাল্ট এর কয়েকদিন পর আমি জানতে পারি যে আমি টিকেছি।অথচ তখন রিটেনের জন্য সময় নাই।
আল্লাহ তায়ালা আমার প্রতি সর্বদা কৃপা দেখান। হয়তো তার জন্যই ৯ তারিখের রিটেন পরীক্ষা পিছিয়ে ১৬ তারিখ করা হয়।

এদিকে আমার ১ম রিটেন।কিছুই জানিনা।আমার বান্ধবী দৃষ্টি জনতা ব্যাংকে ছিলো।
ও আমাকে বিগত সালের প্রশ্নের ম্যাথ আর মহিদ’স সম্পাদকীয় পড়ার উপদেশ দেয়।
আমি অনলাইনে একটা ফোকাস রাইটিং এর বই অর্ডার দেই।আমার জীবনের ১ম অনলাইন শপিং  মেয়েরা সাজুগুজু দেয় আর আমি দিলাম বই।বাসায় বললাম আমাকে এই ৬ টা দিন একটু পড়তে দাও।রিটেন টা একটু কষ্ট করে দেই।
এরপর মাত্র ৬ দিন মোটামুটি পড়লাম।
পরীক্ষায় সব ভাল লিখলাম তবে ম্যাথ হলো মাত্র ২ টা।  সবার যেখানে ৪/৫ টা সেখানে ২ ম্যাথ নিয়ে আশা করা বোকামি।
তবুও একটা বিশ্বাস রাখলাম কারন অনেকেই ফোকাস রাইটিং ভাল লেখেনি।
এরপর রিটেনেও টিকলাম।সেদিন খুব খুশি লাগছিলো।
ভাইভা ছিলো ৭ এপ্রিল।ভাইভাটাও দারুন মজার ছিলো।

ভাইভা দেবার পর মনে হলো আমি যদি একদম প্রিপারেশন ছাড়া ভাইভার দুয়ারে যাই তবে হয়তো একটু পড়াশুনা করলে হয়তো পারব।এরপর দোকানে একটু কম সময় দিয়ে একটু পড়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করি।কিন্তু বাসায় এত গ্যানজামে আড্ডা ই হয়।

তবে আমি সময় নষ্ট করতাম না।দোকানে যতক্ষণ বসতাম একটা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা কোন না কোন mcq টাইপ বই থাকতো।কাস্টমার গেলে পড়তাম।
অনেকে টিটকারিও মারতো যে দেখানো পড়া পড়ছি।স্টুডেন্ট এর বাসায় ওদের পড়া দিয়েও টুকটাক পড়তাম।এর জন্য একবার এক গার্ডিয়ান কথাও শুনিয়েছিলো যে তার বাচ্চা পড়াতে আসছি নাকি নিজে পড়তে আসছি।

ফেসবুকে আমি সবসময় অ্যাকটিভ থাকতাম।বিভিন্ন গ্রুপ এ কাজ করা। পোস্ট দেয়া/কমেন্ট রিপ্লাই যেন একটা নেশা।
এর মাঝেও ব্যাংক গ্রুপের পোস্ট সবসময় ই পড়তাম।

স্টুডেন্ট পড়ানোটাই আমার সবথেকে বড় শক্তি আমি মনে করি।নাহলে কিছুই হতোনা।যতই আমি বলি পড়িনি তবে এগুলোই হয়তো আমার পড়াশুনা ছিলো।
অনেকে মজা করে বলে সারাদিন ৩/৪ টা পোস্ট দিয়ে,এত ফেসবুকে থেকে, দোকানদারি করেও কিভাবে চাকরি হলো???
লোক আছে নাকি? কয় টাকা লাগলো।

তখন শুধু হাসি।

আমার মনোবল
আমার অনুপ্রেরণা

ছোটকাল এ প্রথম আলো পেপারে যখন নিউজ দেখতাম ” রিকসা চালিয়ে এ প্লাস”
“চা এর দোকান চালিয়ে এ প্লাস”
তখন থেকেই একটা অনুপ্রেরণা কাজ করতো।একদিন আমিও কারো অনুপ্রেরণা হতে পারি হয়তো।

আমার টিচার দের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক স্যার/ম্যাম এর কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি তা আমি সবসময় মনে করি।এগুলোর মাধ্যমে শক্তি পাই।আয়নার সামনে দাড়িয়ে সবসময় নিজেকে সাহস দিতাম। #আমিও_পারি কবিতা সহ অনেক কবিতায় ও অনুপ্রাণিত হয়েছি।
কিছু পড়ি বা না পড়ি জীবন যুদ্ধে জয়ী মানুষগুলোর ব্যার্থতার গল্প+সফল হবার গল্প পড়ি।এগুলো আমার মনোবল কে অনেক দৃঢ় করে।এক পা নিয়ে যদি এভারেস্ট জয় করতে পারেন,অভাবে না খেয়ে,বাদাম বেঁচেও যদি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন সেখানে এত ভাল থেকেও আমি পারব না কেন??

স্কুলের হেডম্যাম বলেছিলেন,”আচরনের স্থায়ী পরিবর্তন ই শিক্ষা, হতে পারে কুশিক্ষা বা সুশিক্ষা, কোনটা নেবে তা তোমার ব্যাপার”

কলেজের তবারেকা ম্যাম বলেছিলেন,”একটা মেয়েকে সফল হতে গেলে ১০টা ছেলের থেকেও শক্তিশালী মনোবল থাকতে হয়”

যশোর ক্যান্ট এর আশরাফুল স্যার লাস্ট ক্লাসে বলছিলেন “নিজেকে ভাল কাজের জন্য ধন্যবাদ দিও,যদি নিজে নিজেকে মূল্যায়ন না করতে পরো তবে আরেকজন যে মূল্যায়ন করবে এটা আশা করা বোকামি”

তাজ স্যার বলেছিলেন” মনি রে,চুলকানি আর প্রতিভা লুকানো যায় না,তোর চেষ্টাই তোকে অনেক উপরে নিয়ে যাবে”

মমতাজ স্যার বলেছিলেন,” সবসময় সৎ থাকবা,মানুষের উপকার করবা,দোয়া অনেক বড় জিনিস”

টিটু স্যার বলতেন,”বিসিএস হোক বা না হোক,তুই আমার কাছে ক্যাডার”

শম্পা ম্যাম বলতেন,”মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুব জরুরী।”

নিগার ম্যাম বলেছিলেন,”লিখাপড়ার কোন বিকল্প নাই,মেয়েদের ফ্যাক ফ্যাক করে কান্না করা যতদিন না যাবে ততদিন এদের দ্বারা কিছু হবেনা।”

আমার মা বলেন,” মানুষের দোয়ার উপরে কিছু নাই।আজ কারো জন্য ভাল কিছু করলে অবশ্যই তার ভাল ফল আল্লাহ দেবেন।মানুষের উপকার করবা,আর কখনো অহংকার করবা না”

এরকম অনেক মানুষের কথা বলতে পারব যাদের কথাই ছিলো আমর কাছে অনুপ্রেরণা। তার উপর বিখ্যাত মানুষের গল্প তো আছেই।

আমি বিশ্বাস করি সবার দোয়াতেই আমি আজ এ পর্যন্ত। ২০১৮ সালের পর থেকে আল্লাহর রহমতে অনেক স্বচ্ছল আছি।

গত ১৮ মে আমার প্যানেলে সোনালী ব্যাংক এ চাকরি হবার আব্বু আম্মু আর ভাই এর চোখে মুখে যে আনন্দ দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।এই দিনটা দেখার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম।

রেজাল্টের পর আমার আব্বু তার সেই পরিবহনের কলিগ দের কল দিয়ে গর্বের সাথে বলেছেন তিনি একজন সরকারী চাকুরীজীবির বাবা হতে যাচ্ছেন।
অথচ তারাই বলতো মেয়েদের এত পড়াতে হবে কেন?বয়স হয়ে যাচ্ছে,বিয়ে দেন, আরো অনেক কিছু।
মুখে কিছু না বললেও অনেক মানুষ কেই জবাব দেয়া হয়ে গেছে যারা প্রতি পদে পদে অপদস্ত করেছেন।

আমার বড় শক্তি আমি হাসিমুখে থাকতে পারি।মানুষকে ভালবাসতে পারি।
এটা আমার পথচলা শুরু।যেতে হবে অনেকদূর।যারা একটুতেই হতাশ তাদের জন্য বলব,হতাশা কয়েকধাপ পিছিয়ে দেয় যেখানে মনোবল,আত্নবিশ্বাস আর প্রচেষ্টা এগিয়ে দেয় কয়েকধাপ।

চেষ্টা করও যদি না পারেন তবে ভাববেন অন্য কেও আপনার থেকে বেশি চেষ্টা করেছেন আর আপনার জন্য অন্য ভাল কিছু অপেক্ষা করছে।হাল ছেড়ে দিলে সব হারাবেন।মনের শক্তি বড় শক্তি।

অনেক সময় নিয়ে লেখেছি।অনেক অনেক কিছু বলতে পারিনি।তবুও কেও যদি পড়ে অনুধাবন করেন যে একজন মেয়ে এত কষ্ট করে ডাবল এমবিএ করে,দোকান চালিয়ে,৭ ঘন্টা টানা স্টুডেন্ট পড়িয়েও যদি ভাল কিছু করে বা করার স্বপ্ন দেখে তবে আপনিও পারবেন ইনশাআল্লাহ।

শেখ সাদী বলেছেন, “নিজের হাতের উপার্জিত রুটি,অন্যের দয়ায় দেওয়া কোরমা,পোলাওয়ের চাইতেও উত্তম”

হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন,”অবশ্যই তুমি পাবে যা তোমার থেকে চলে গেছে তার চেয়েও উত্তম”

“Blv u can & u’re halfway there”—-Roosevelt.

সবার সফলতার গল্প পড়তাম।ভাবতাম আমিও লিখব কোনদিন।অনেক কিছুই লেখা হলোনা।
তবুও এত বড় লেখা কেও যদি পড়ে তবে এত সময় নিয়ে লেখাটা সার্থক হবে।শেষে একটা কথা বলে বিদায় নেব ” You have to fight through some bad days to earn the best days of your life….
Accept ur past without regret, handle ur present with confidence & face ur future without fear……..”

সবার জন্য শুভ কামনা।দোয়া করবেন যেন জীবনে সফল হতে পারি।ধন্যবাদ।

ফাইল ছবি

সূত্রঃ নাসরিন রুনা’র ফেইস বুক

বাংলাদেশ সময়: ১৬:০৮:০৬   ১৭৮৬ বার পঠিত   #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ফিচার’র আরও খবর


অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে তৃতীয় বর্ষে রবিকর ফাউন্ডেশন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রক্ষায় প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির পর্যালোচনা
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
মোহাম্মদ শাহ আলমের জীবন ও কর্ম
ইসফাহান নেসফে জাহান
সিলেটে গ্রুপ ফেডারেশনের কর্মশালায় বির্তকিত মুরাদ- আয়োজকদের দুঃখ প্রকাশ
ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, টাকার দাম কেন কমছে

আর্কাইভ