শ্রদ্ধেয় গুরুকুল নিয়ে কথা-স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » সাহিত্য » শ্রদ্ধেয় গুরুকুল নিয়ে কথা-স্বপন চক্রবর্তীদীপান্বিত গুরুকুল নিয়ে গত কয়েক দিন লিখেছি । লিখতে গিয়ে গুরুর প্রতি ভক্তি, হতাশা ও কর্তব্য নিয়ে আরও দু’একটি কথা এখন উল্লেখ করতে চাই। যদিও কথাগুলো সবার জানা । শিক্ষকের প্রতি ইদানীং যেমন অবহেলা, শিক্ষক হত্যা ও আক্রমণ ক্রমাগত ভাবে সংঘটিত হয়ে চলছে, তাতে কিছুটা হতাশাগ্রস্তও হয়েছি। আমার পিতাও প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তখন আশপাশের গ্রামেও কোন শিক্ষক ছিল না।
১। বাল্যকালে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ”ওস্তাদের কদর” নামে একটি কবিতা পড়েছিলাম। কবিতাটি সম্ভবত এখন “ শিক্ষকের মর্যাদা” কোথাও আবার “ শিক্ষাগুরুর মর্যাদা” নামে পাঠ্য আছে। কবিতাটির বিষয়বস্তু এইরূপ- দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে এক মৌলভী পড়াতেন। একদিন প্রভাতে গিয়ে বাদশাহ আলমগীর দেখেন তার পুত্র একটি পাত্র হাতে নিয়ে গুরুর চরণে জল ঢালতেছে। এ দৃশ্য বাদশাহ দেখে ফেলেছেন বলে ওস্তাদ খুব শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় পরদিন সকালে বাদশার ডাক পেলেন মৌলভী। ভয়ে আরও জড়সড় অবস্থা। কিন্তু ওস্তাদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি ওস্তাদ, তাই তিনি কোন ভুল করেননি। বাদশা আলমগীর ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলেন, “ শুনুন জনাব,পুত্র আমার আপনার কাছ থেকে সৌজন্য কি কিছু শিখেছে ? বরং শিখেছে বেয়াদপী। আমি দুরে দাঁড়ায়ে দেখলাম, আমার পুত্র পাত্র নিয়ে আপনার পায়ে জল ঢালছে, সে নিজ হাতে কেন আপনার পা বুলায়ে সযতনে ধুয়ে দেয়নি ? এ কথা স্মরণ করে বড় ব্যাথা পাচ্ছি”। তখন মৌলভী সাহেব কুর্নিশ করে সগৌরবে উচ্চস্বরে বলেন “ আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর”। অর্থাৎ শিক্ষাগুরুর মর্যাদা মাতা-পিতার পরেই বিবেচ্য।
২। ভক্তি আরুণি-
ধৌম্য আচর্য গুরুর এক শিষ্য ছিল আরুণি। গুরুগৃহে থেকে সে শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করছিল। গুরু একদিন শিষ্য আরুণিকে পাঠালেন ক্ষেতের আল বেঁধে পানি রক্ষা করতে। আরুণি গুরুর আদেশে ক্ষেতের জল আটকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশেষে আলে শুয়ে পড়ে জল আটকালো। দিন শেষে গৃহে না ফেরায় গুরু শিষ্য আরুণিকে খোঁজতে বের হলেন। তিনি ডাকাডাকি করতে করতে এগুচ্ছিলেন। ক্ষেতের আলে শুয়ে আরুণি ঠান্ডায় আড়ষ্ঠ। শেষে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জড়সড় আরুণি জবাব দেয়, “ আমি এখানে গুরুদেব”। গুরুদেব কাছে গিয়ে সব দেখে অবাক হলেন । জানতে চাইলেন এমনভাবে শুয়ে থাকার কারণ। তখন আরুণি বলে যে, গুরুদেব, জলের তোড়ে কোন বাধ মানতেছিল না। তাই জলের আলে শুয়ে জল আটকে রেখেছি। গুরুদেব ধৌম্য আচার্য তখন খুব ব্যথিত হলেন এবং সঙ্গে করে শিষ্য আরুণিকে নিয়ে আশ্রমে গেলেন।
৩। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কারাম দুঃখ করে একদিন বলে ছিলেন, ভারতবর্ষে ডাক্তার চান তার ছেলে ডাক্তার হোক, প্রকৌশলী চান তার ছেলে প্রকৌশলী হোক, পুলিশ অফিসার চান তার ছেলে পুলিশ অফিসার হোক। শুধু শিক্ষকরাই চান না তার ছেলে শিক্ষক হোক।
৪। বৃটিশ সরকার একবার প্রখ্যাত কবি, দার্শনিক আল্লামা ইকবালকে “ স্যার” উপাধি দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে। আল্লামা ইকবাল জানালেন- এটা তো সম্ভব না। আমাকে কোন উপাধি দেওয়ার আগে আমার শিক্ষক মৌলভী মীর হাসানকে দিতে হবে। বৃটিশ প্রতিনিধিরা তো অবাক। এটা কি করে সম্ভব? নানা ক্ষেত্রে আপনি অসামান্য অবদান রেখেছেন, নতুন চিন্তা, দর্শন,মতাদর্শ তৈরী করেছেন। কিন্তু আপনার শিক্ষক কি এমন করেছেন যে, তাকে বৃটিশ সরকারে স্বীকৃতি দিতে হবে? জবাবে আল্লামা ইকবাল বললেন- তিনি আমাকে তৈরী করেছেন। আল্লামা ইকবালের শিক্ষক মৌলভী মীর হাসানকে শামছুল উলামা খেতাব য়োর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। - ইকবাল জানালেন-উনার শরীর ভালো না। উনি এখানে আসতে পারবেন না। আপনাদের শিয়ালকোটে তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়ে এই উপাধি প্রদান করতে হবে। ইকবালের অনমনীয় ইচ্ছা মেনে নিয়ে বৃটিশ প্রতিনিধি দল শিয়ালকোট গিয়ে মৌলভী মীর হাসানকে শামছুল উলামা খেতাবে ভূষিত করে। ইকবালের জন্যই মীর হাসানকে মানুষ চিনেছেন। আর মীর হাসানের জন্য ইকবালের মতো দার্শনিক তৈরী হয়েছে। এটাই হলো একজন ছাত্রের একজন শিক্ষকের প্রতি দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধ।
৫। পদার্থে নোবেল পাওয়া প্রফেসর সালাম বললেন – আমার স্কুল শিক্ষক অনীলেন্দ্র গাঙ্গুলী না থাকলে আমি আজকের সালাম হতাম না। এই সম্মান আমার শৈশবের সেই শিক্ষকের প্রাপ্য। তিনি ভারত সরকারের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, তার শৈশবের শিক্ষককে খুঁজে বের করতে। তাকে খুঁজে বের করা হলো। প্রফেসর সালামের সাথে কথা বলার আয়োজন করা হলো। প্রফেসর সালাম কুশলাদি বিনিময় করে সব কিছু বললেন, শুধু নিজের নোবেল প্রাপ্তির খবরটুকু বললেন না। তিনি বললেন- এই খবর আমি স্বশরীরে উনার কাছে গিয়ে দিতে চাই। তিনি তাই করলেন। পরের সপ্তাহে তিনি শিক্ষক গাঙ্গুলীর ভিটেয় উপস্থিত হয়ে তার হাতের স্পর্শ মাথায় নিয়ে নোবেল প্রাপ্তির খবর জানালেন। এটাই হলো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের বিনয়। এটাই হলো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ভক্তি, শ্রদ্ধা ভালোবাসা।
৬। ফিনল্যান্ডে সবচেয়ে মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। আর আমাদের ও ভারত বর্ষের বেলায় এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। শিক্ষা বিভাগগুলো এখানে অবহেলিত। ফলে একজন শিক্ষা ক্যাডার চান অন্য ক্যাডারে যেতে। কারণ অন্যান্য বিশেষ ক্যাডার গুলোতে এতো ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, একজন শিক্ষককে তাদের সামনে নতজানু হয়ে থাকতে হয়।
একবার নানা পেশার মানুষের একটি কনফারেন্সে এক বড় কর্পোরেট সিইও শিক্ষককে বললেন, - যেখানে আপনারাই একান্ত বাধ্য হয়ে শিক্ষক হয়েছেন, সেখানে সত্যি করে বলুন ,আসলে আপনারা ছাত্র-ছাত্রীদের কি শিক্ষা দেন ? কিন্তু একজন প্রাথমিক শিক্ষক দাঁড়িয়ে বললেন- কি আর করি ? মাতা-পিতারা সন্তানকে যেখানে মাত্র পাঁচ মিনিট ডিভাইস ছাড়া বসিয়ে রাখতে পারেন না, সেখানে আমরা পুরো ঘন্টা বসিয়ে রাখতে পারি। প্রতিটি ছাত্রের ভিতর বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আর জানার আগ্রহ তৈরী করি। ভুল হলে ক্ষমা চাওয়ার মনোভাব তৈরী করি। অপরকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা তৈরী করি। অক্ষর জ্ঞান দান করি। পড়তে লিখতে সাহায্য করি।শুধু ক্যালকুলেটর নয়, স্রষ্টা প্রদত্ত ব্রেণকে ব্যবহার করার কৌশল শিখাতে চেষ্টা করি। আরও জানতে চান কি? পৃথিবীর যতো বড়ো ডাক্তার , প্রকৌশলী কিংবা আপনার মতো সিইও হোক , তাদের হাতে খড়ি হয়েছে কোনো না কোন শিক্ষকের কাছেই। আমি তাদেরই একজন। আমি আমার পেশা নিয়ে গর্ববোধ করি। কাজেই একজন শিক্ষক হয়তো অর্থ বা ক্ষমতার দিক দিয়ে বড় কেউ নন। কিন্তু মহত্ব এবং মর্যাদার দিক থেকে সবচেয়ে উুঁচু জায়গায় তাঁদের অবস্থান। ম্যানকে হিউম্যান বানানোর কারিগর সকল শিক্ষককে সালাস, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
বাংলাদেশ সময়: ২১:০১:১৯ ৩৮৪ বার পঠিত #কিছু কথা #ভক্তি ও হতাশা #শ্রদ্ধেয় গুরুকুল
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)সাহিত্য’র আরও খবর
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]