সোমবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২২

সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: পর্ব-৩ ( শেষ ) :স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: পর্ব-৩ ( শেষ ) :স্বপন চক্রবর্তী
সোমবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২২


সংগৃহীত ছবি-সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন

শ্যামা সঙ্গীতের রূপকথা
হালিশহর গঙ্গার বুকে নিজের বজরায় বসে রামপ্রসাদ সেনের গান শুনে মুগ্ধ ও অভিভূত নবাব বিদায় নেবার আগে নাকি রামপ্রসাদ সেনকে মুর্শিদাবাদ আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। যদিও সেই অনুরোধ পরবর্তী সময়ে রাখতে পারেননি সাধক কবি। কেননা তার কিছুদিন পর সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ। যে যুদ্ধে ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন পরাজিত নবাব সিরাজ উদদৌলা। রামপ্রসাদ সেনের বয়স তখন মাত্র সাইত্রিশ বছর।
দুই মৃত্যুর অভিঘাত।
রামপ্রসাদ সেনের জীবনে দু’জন মানুষের মৃত্যু গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মৃত্যু এবং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যূ। রামপ্রসাদ সেন বরাবরেই ছিলেন মা অন্তপ্রাণ। তার কাছে গর্ভধারিণী মা আর আরাধ্যা মা কালীর মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলনা। মায়ের মৃত্যুতে তিনি যেমন গভীর আঘাত পেয়ে ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে মা কালীর সাধনায় তিনি আরও বেশী করে ঐকান্তিক ভাবে নিজেকে নিবেদন করতে পেরে ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর আঘাতে সংসারের সব বাঁধন যেন ছিঁড়ে গিয়েছিল। কারণ তার পরই তিনি মেতে উঠেছিলেন মা-কালীর কঠোর কঠিন সাধনায়। নিজের বাড়ির বাগানের একটি কোনে রামপ্রসাদ সেন আগেই তৈরী করে রেখে ছিলেন পঞ্চবটি বন। সেখানেই পঞ্চমুন্ডাসন প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। বাড়ির কাছেই সাধন মন্টপ তৈরী ছিল অনেক আগেই। কিংবদন্তী অনুসারে এই পঞ্চবটি বনেই মাতৃসাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন। অন্য দিকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন তার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ,প্রিয় বন্ধু। তার বিয়োগ ব্যথায় তিনি এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, নবদ্বীপ যাত্রায় তিনি কখনও সামিল হননি। এক সময় মহারাজার অনুরোধে প্রায়ই তিনি নবদ্বীপ যেতেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে গান শুনানোর জন্য । এখানেই একটি অত্যন্ত সুন্দর একটি গল্প আছে। গল্পটি হলো , মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনের শেষ পর্বে যখন সাধক কবি মহারাজার সাথে দেখা করতে যান সেসময়ে পথে তিনি ভয়ংকর ডাকাত দলের খপ্পরে পড়েন। সে ডাকাত দল ছিল পাশ বেড়িয়ার বিখ্যাত ডাকাত বুধোর দল। মাকালীর সামনে নরবলি দিয়ে বুধো ডাকাত বরাবর ডাকাতি করতে বের হতো। সেবার নরবলি দেবার জন্য সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনকে ধরে নিয়ে তার আস্তানায় হাজির করে ছিল। শুনা যায়, বলি দেবার জন্য যেইমাত্র বুধো ডাকাত রামপ্রসাদ সেনের মাথার উপর খড়গ তুলে ধরেছিল ,সেই মুহুর্তে রামপ্রসাদ সেন গান ধরে ছিলেন –
“ তিলেক দাঁড়া ওরে সমন
বদন ভরে মাকে ডাকি।
আমার বিপদকালে ব্রহ্মময়ী
আসেন কিনা আসেন দেখি।”
রামপ্রসাদের সেই গান শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বুধো ডাকাতের খড়গ। দ্রুত সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল ডাকাতদল। কিংবদন্তী অনুসারে ডাকাতেরা ভুল বুঝে ক্ষমা প্রার্থনা করে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনকে হালিশহরে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল।
১৭৮১ সাল। দুর্গাপূজা শেষ হবার পর সে বছরই ১৬ই অক্টোবর মঙ্গলবার কালীপূজার অমাবস্যা। প্রতি বছর ঐ দিনটিতে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন মহা সমারোহে কালী পূজা করেন। নিজের হাতে প্রতিমা গড়েন। সারা রাত ধরে চলে তার পূজা। আর পূজার ফাঁকে ফাঁকে আপন মনে মাকে তিনি গান শুনান। গুটা হালিশহরের লোক অপেক্ষা করে থাকেন এই কালী পূজা দেখবেন বলে। পরের দিন যথারীতি প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন হবে। এমন সময় রামপ্রসাদ সেন নাকি ঘনিষ্ঠজনকে বলে ছিলেন, আজ মায়ের বিসর্জনের সঙ্গে আমারও বিসর্জন হবে। বিসর্জনের সময় মাথায় ঘট নিয়ে গঙ্গায় নেমে মায়ের প্রতিমার দিকে চেয়ে থেকে রামপ্রসাদ সেন গাইতে লাগলেন একের পর এক গান। চতুর্থ গানের শেষ দুটি লাইন ছিল-
প্রসাদ বলে মন দৃঢ়,
দক্ষিণার জোর বড়।
ওমা, আমার দফা হলো রফা
দক্ষিণা হয়েছে।
কিংবদন্তি অনুসারে “ দক্ষিণা হয়েছে “ এই কথাটি গাইবার পর মুহূর্তেই নাকি সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের প্রাণ বায়ু বেড়িয়ে যায়। শরীর লুটিয়ে পড়ে গঙ্গার জলে। চলে গেলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন।
আজ এ কথা বললে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, হালিশহর তথা সমগ্র বাংলার মানুষ নিজেদেরকে ধন্য মনে করেন এই কারণে যে, রামপ্রসাদ সেনের মত এমন একজন যোগপুরুষ সাধক কবি , এই বাংলার মাটিতেই জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। এই মাটিই ছিল তার গর্ভ ভূমি। বস্তুত যতদিন বাংলাভাষা থাকবে বাঙ্গালীর কন্ঠে সুর থাকবে , বাঙ্গালী জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবে , ততোদিন যে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের গান বাঙ্গালীর প্রাণে ভক্তি প্রেমের এক অপূর্ব অমৃত তরঙ্গ হিসেবে প্রবাহিত হবে ,তার গানের গৌরব চতুর্দিকে যে প্রচারিত হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্রসূত্রঃ-
১। রামপ্রসাদ:- পার্থপ্রতীম বন্দোপাধ্যায়।
২। সাধক রামপ্রসাদ:- জ্যোতিপ্রকাশ সেনগুপ্ত।
৩। এই সময় সংবাদপত্র।
৪। মান্না দের শ্যামাসঙ্গীত।
৫। উইকিপিডিয়া ।

বাংলাদেশ সময়: ২০:২৮:৫৬ ● ৫২০ বার পঠিত