রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন: পর্ব ২৯২-জালাল উদ্দীন মাহমুদ

Home Page » সাহিত্য » রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন: পর্ব ২৯২-জালাল উদ্দীন মাহমুদ
সোমবার ● ১২ জুন ২০২৩


জালাল উদ্দীন মাহমুদ

ছুটি নিয়ে ছুটাছুটি -৪

কয়েক মাস পরেই এ ভালো মানুষ স্যারটি বদলি হয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। আর একজন ডিজিএম সাহেব আসলেন। তিনি নিপাট ভদ্রলোক। মাটির মানুষ। তার মতো ভালো মানুষ জগতে বিরল। প্রায় মাস খানেক পর স্যার যখন ডিভিশনের কাজকর্ম একটু বুঝে উঠলেন তখন একদিন আমাকে ডাকলেন। বললেন, এখানকার অনেক ফাইল তো আপনার কাছে। আপনার একটু কাজের লোড বেশি । আগে থেকেই এটা চলে আসছে। আমার আর এখন কিছু করার নাই। আপনি একটু কেয়ারফুল কাজ করেন- প্রয়োজনে একটু আগে অফিসে আসেন। তাছাড়া আমি অসুবিধায় পড়ে যাব।
আমার কাজের লোড বেশি এটা আমিও জানি। কাজ করছিও তবু স্যারের অনুরোধে অফিস শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেই অফিসে আসা শুরু করলাম। সে বিল্ডিং-এ আবার অফিস শেষে কেউ থাকতো না । তাই পারতপক্ষে লেট সির্টিং যেনও না হয় সবাই সে চেষ্টায় থাকতো।
এক সময় দেখলাম আমার আগেই ডিজিএম সাহেব অফিসে আসছেন। একদিন সবিনয়ে কারণ জিজ্ঞাসা কললাম ।
- আমার বাসায় আর ভালো লাগে না।
- কেনো স্যার ?
- নানান কারন । এই ধরেন আমি বাপ-দাদার আমলের টিনশেড বাড়িতে থাকি। খুব গরম।বাবা বেঁচে আছেন । বাবাকে নিয়ে ফ্লাট বাড়িতে উঠার শখ ছিল । বাবা গরম থেকে একটু বাঁচতেন। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে ফ্লাট বুকিং দিয়েছিলাম। কিস্তির টাকা শোধও করেছি। নামকরা কোম্পানি। কিন্তু তারা টাকা নিয়েছে বটে , ফ্লাটের কাজ শেষ করেনি। শেষ করার কোনো লক্ষনও দেখি না।
- খুবই দুঃখজনক স্যার।
- কিন্তু এখন আমার দুঃখের কারন এটা নয়।
- -তাহলে কোনটা ?
- জানেন গত সপ্তাহে একটা ফাইল নিয়ে এমডি স্যারের কাছে গিয়েছি ,উনি ফাইলের কিছু ভুল ধরলেন। বিরক্ত হলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন –কী পাশ ? আমি বললাম এম বি এ । উনি বললেন-কোথা থেকে । বললাম –ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই বি এ থেকে । উনি বললেন যত সব আজগুবি কথা। আমি বিশ্বাস করি না । তারপর ফাইলটা ছুঁড়ে মারার ভঙ্গিতে আমাকে ফেরৎ দিলেন।
সেই থেকে আমার আর কিছুই ভালো লাগে না। বাসায় থাকতে ইচ্ছে করেনা । সকাল সকাল অফিসে এসে বসে থাকি।
কিছুক্ষণ থেমে সার বিড়বিড় করে বললেন-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই বি এ থেকে এম বি এ পাশ করেছি । কেউ বিশ্বাস না করলে আমি কী আর করতে পারি।আমি তো মিথ্যা বলেনি। আমি তো মিথ্যা বলেনি।
আমি তো মিথ্যা বলেনি কথাটা কয়েকবার বলার পর স্যার মাথাটা বাম পাশে কাত করে চেয়ারে অজ্ঞান হবার মত অসাড় হয়ে পড়লেন।
আমি স্যারের চেম্বার থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে পিওন বাকীবিল্লাহকে খুঁজে খুঁজে ডেকে আনলাম । ততক্ষনে স্যার দেখি স্বাভাবিক হয়ে গেছেন।
আমাকে কাছে ডেকে বললেন – আপনি একটু খেয়াল রাখবেন কোনও কাজ যেন পেন্ডিং না থাকে ।
আমি স্যারকে অভয় দিলাম।
পরের দিন আমি স্যারের কাছে ছুটি নিতে গেলাম। পরশু রংপুর ক্যাডেট কলেজের প্যারেন্টস ডে। ছেলে অপেক্ষা করবে।যাবার পথে আবার বগুড়ায় মা-বাবাকে দেখতে যেতে হয়। আমি রংপুর যাব অথচ বগুড়ায় বাবা মাকে এক নজর চোখের দেখাও দেখতে যাবনা , এটা হয়না। ফেরার সময় নাইট কোচে ডাইরেক্ট রংপুর থেকে ঢাকায় আসব ।
যা হোক সে সময় স্যার একটা নোট ফাইল পড়ছিলেন। আমি ছুটি নিব শুনেই উনি ফাইলটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিলেন ।
বললেন-কি বললেন জালাল সাহেব? ছুটি লাগবে? কবে?
-পরশু তো শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। আগামি কাল ছুটি লাগবে।
-বন্যাদূর্গত এলাকার কৃষকদের সুদ সরকার মাফ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতিমালা প্রেরন করেছে। এমডি সাহেব আমাদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিষয়টি পাশ করে নিতে বলেছেন। নোটপত্র ও নীতিমালা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে আপনাকেই তৈরী করতে হবে।
-দরকার হলে লেট সিটিং করে কাজ শেষ করব। সব সময় তা করেও আসছি আর আমি তো মাসে মাত্র একদিন ছুটি নেই তাও প্রত্যেক মাসে লাগে না।
-ছুটি না নিলে হয় না ?
ছুটি নিয়ে এত তদবির ভালো লাগে না। আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম-
-আমার একদিন ছুটি লাগবেই স্যার।
-লাগবেই? স্যার জিজ্ঞাসা করলেন। আমি মাথা ঝাঁকালাম।
-কেন এত জরুরী। স্যার নিশ্চিত হতে চাইলেন। আমি কারন ব্যাখ্যা করলাম। স্যার সব শুনলেন। ছুটি যে আমার দরকার তাও বুঝলেন মনে হয়। হাই তুললেন।
অস্ফুট স্বরে বললেন,-আপনি ছুটিতে গেলে আমি চলব কেমনে? এই বলে মাথাটা বাম পাশে কাত করে চেয়ারে অজ্ঞান হবার মত অসাড় হয়ে পড়লেন। আমি ভয় পেলাম না। কারন আমি আগেই শুনেছিলাম -স্যার টেনশনে পড়লে এ রকম হয়। একটা সময় পরে ঠিক হয়ে যায়। ভয় পাবার কিছু নাই।
আমি স্টাফ অফিসার সাহেবের কাছে গেলে উনি বললেন-আপনি যেহেতু স্যারকে ইনফর্ম করেছেন-অতএব আপনি আমার কাছে দরখাস্ত রেখে ছুটিতে যান। কোনও অসুবিধা হবে না। আর অসুবিধা হলে আমি দেখব। তবে দেশী ভাইজান আপনার মোবাইল ফোনটা কি একটু দেয়া যাবে।আমি একটা জরুরী কল করতাম।
সে যুগে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না।স্টাফ অফিসার সাহেব বহুবার আমার মোবাইল থেকে ফোন করেছে, আজও করতে দিলাম।
এ ডিজিএম স্যার যত মাস এ বিভাগে ছিলেন, তত মাসই এ একই প্রক্রিয়ায় আমাকে ছুটি নিতে হয়েছে।
( চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ৮:৪৮:১৫ ● ২৮১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ