৭ হাজার কোটি টাকা জলে

Home Page » জাতীয় » ৭ হাজার কোটি টাকা জলে
মঙ্গলবার ● ৮ আগস্ট ২০২৩


কোটি টাকা জলে

বঙ্গ-নিউজঃ    দুই দশক ধরে চট্টগ্রামের দুঃখ হয়ে আছে জলাবদ্ধতা। প্রধান এই সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দিয়ে গত ২০ বছরে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন চারজন। ইশতেহারে এটি এক নম্বরে রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হলেও জনগণকে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেননি কোনো মেয়রই। অথচ দুই হাজার ১০২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে তাদের হাত দিয়ে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসনে টাকা খরচ করেছে দুই হাতে। এই খাতে তাদের খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডও আলাদা করে খরচ করেছে ২৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন সংস্থা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। উল্টো জলাবদ্ধতার প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার পর থেকে নিত্যনতুন মাত্রা পাচ্ছে দুর্ভোগ। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আগে যেখানে হাঁটুপানি হতো, এখন সেখানে জমছে কোমরপানি।

তবে সরকার অঢেল টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পরও এ সমস্যা থেকে মুক্তি না মেলার তিনটি কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করা সরকারি দুই সংস্থা চসিক ও সিডিএর মধ্যে সমন্বয় নেই। যথাযথভাবে সমীক্ষা না করে প্রকল্প গ্রহণ করা ও নিজ দায়িত্ব পালন না করে একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর মানসিকতাও এ প্রকল্প থেকে সুফল না আসার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী  বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নেই। এরপরও মানুষ সিটি করপোরেশনকে গালাগাল করছে। সিডিএ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু তারা করপোরেশনকে কোনো কিছুই জানায় না। ইচ্ছামতো কাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে সিডিএ চেয়ারম্যান জহুরুল আলম দোভাষের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি সাড়া দেননি। তবে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, সিটি করপোরেশন নালা-নর্দমাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করছে না। যার কারণে নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ কারণে জলাবদ্ধতা বেশি হচ্ছে।

সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী বলেন, আমাদের যেভাবে প্রকল্প বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে কাজ করছি। ৪০টির মধ্যে পাঁচটি স্লুইসগেট তৈরির দায়িত্বে ছিলাম আমরা। সবকটির কাজ আমরা সম্পন্ন করেছি। কিছু জলকপাট সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের করার কথা। সেগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

চার মেয়রের যত ব্যয়

সিটি করপোরেশনের বাজেট বই বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় হয় ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ২০১০ সালে দায়িত্বে এসে মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম ব্যয় করেন ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন খরচ করেন ৫৮৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর দুই বছরে খরচ হয়েছে ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই হিসাবে চার মেয়রের হাত দিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ২০ বছরে ব্যয় হয়েছে ৯২৭ কোটি টাকা। এর বাইরে নতুন খাল খননে ইতোমধ্যে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এ অর্থ ব্যয় করেন।

সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে সিডিএ

জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছে সিডিএ। এ সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও বর্তমান চেয়ারম্যান জহুরুল আলম দোভাষ খরচ করেন ৪ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। জলাবদ্ধতা নিরসনের মেগা প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করছেন তারা। সিডিএ ও চসিকের বাইরে পানি উন্নয়ন বোর্ড জলাবদ্ধতা নিরসনে এখন পর্যন্ত খরচ করে ফেলেছে ২৩৬ কোটি টাকা।

প্রকল্পের সুফল না পাওয়ার প্রধান কারণ

অঢেল অর্থ খরচ করার পরও কেন সুফল মিলছে না জলাবদ্ধতা প্রকল্পের– এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে নতুন চারটি খাল খননের কথা বলা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি খালের কাজ ২০১৪ সালে শুরু করলেও আজ পর্যন্ত চসিক তা শেষ করতে পারেনি। আগের মাস্টারপ্ল্যানে প্রথম পর্যায়ের ড্রেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের ড্রেন ও তৃতীয় পর্যায়ের ড্রেনের কথা উল্লেখ ছিল। সরকার যে প্রকল্পগুলো এখন বাস্তবায়ন করছে, সেখানে এ বিষয়গুলো সেভাবে ভাবা হয়নি। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে এসে এখন পানিপ্রবাহ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আটকে যাওয়া পানি বড় খাল বা ড্রেন পর্যন্ত আসতে পারছে না। পরিকল্পনা নেওয়ার আগে যদি যথাযথভাবে সমীক্ষা করা হতো, তাহলে এ দুর্বলতা ধরা পড়ত। জনগণও এটির সুফল পেত। সেবা সংস্থার মধ্যে আছে সমন্বয়হীনতাও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২২টি সেবাদানকারী সংস্থা আছে। প্রধান এ সমস্যা নিরসনে সেবাদানকারী এই সংস্থাগুলোর মধ্যেও আছে সদিচ্ছার অভাব। ২০০০ সালে জলাধার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল সারাদেশে। সেই আইন বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকার কথা ছিল সব সেবা সংস্থার। কিন্তু উল্টো পথে হাঁটছে চট্টগ্রাম। জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ হওয়ার অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে– সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকা। জলাবদ্ধতা প্রকল্পগুলোর আওতায় থাকা জলকপাটগুলো (স্লুইসগেট) যদি চালু করা যেত, তাহলে জোয়ারের পানি ঠেকানো যেত। খালগুলো ঠিকভাবে পরিষ্কার না থাকার কারণেও পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কার কাছে কত টাকার কাজ

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত সর্ববৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এরই মধ্যে এ প্রকল্পে খরচ করা হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। ২ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৬৯ শতাংশ। ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এ প্রকল্পে এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। কাজ শেষ হয়েছে ৫৫ শতাংশ। ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ।

নালায় পড়ে প্রাণ গেল কলেজছাত্রীর

ভারী বৃষ্টির কারণে গতকাল সোমবার চতুর্থ দিনও স্থবির ছিল চট্টগ্রাম। গতকাল সকালে হাটহাজারী উপজেলার ইসলামিয়া হাট বাদামতল এলাকায় নালায় পড়ে নিপা পালিত (২৪) নামে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি একই এলাকার উত্তম পালিতের মেয়ে ও হাটহাজারী সরকারি কলেজের বিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। গতকাল তাঁর দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষায় অংশ নিতে গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। নিপা পালিতের দুর্ঘটনাস্থলটি প্রশাসনিকভাবে হাটহাজারী উপজেলায় হলেও এটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের অধীন। গত দুই বছরে খোলা খাল-নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ মারা গেছেন পাঁচজন। গত সাত বছরে মারা গেছেন ৯ জন। এর মধ্যে একজনের খোঁজ মেলেনি। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। তবুও খোলা নালা-নর্দমা সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি সিটি করপোরেশন।

এদিকে বৃষ্টিতে নগরের রাস্তাঘাট, অলিগলি ও বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা চার দিনের বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম নগরে ১১৩টি প্রাথমিক ও অন্তত ৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম আজ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। কয়েক দিন ধরে এসব বিদ্যালয়ের নিচতলায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমে থাকায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

এ ছাড়া রেললাইনে জলাবদ্ধতার কারণে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান বাহন শাটল ট্রেন। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাস চলাচলও। এ অবস্থায় গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত চারটি বিভাগে চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় তিন দিন বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৩৩:১১ ● ১২৪ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ