ক্যাসিনোর জায়গা নিল অনলাইন

Home Page » প্রথমপাতা » ক্যাসিনোর জায়গা নিল অনলাইন
সোমবার ● ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩


ফাইল ছবি
 বঙ্গ-নিউজঃ     ক্যাসিনোকাণ্ডে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চার বছর আগের অভিযানে শুরু হয়েছিল তোলপাড়। এতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ক্যাসিনো কারবার। তবে ক্যাসিনোর জায়গা দখল করেছে অনলাইন জুয়ার অ্যাপ। একের পর এক অ্যাপ বা ওয়েবসাইট খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চক্র। ঘরে বসেই ডিজিটাল মাধ্যমে অনলাইন জুয়া খেলছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে।

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের শুরুতেই গ্রেপ্তার করা হয় তৎকালীন যুবলীগ নেতা খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ৪৯টি অভিযান চালায় পুলিশ ও র‍্যাব। ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে মোট ৫৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৫১টির অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ ও সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলার তদন্ত এখনও চলছে। এদিকে ক্যাসিনো কারবারে সংশ্লিষ্ট অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়ে রাজনীতিতে ফেরার উপায় খুঁজছেন।

সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ক্যাসিনোকাণ্ডে প্রায় সব মামলার তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। দু-একজনের বিষয়ে তথ্য জানতে দেশের বাইরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠির জবাব পেলেই বাকি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

২০১৯ সালে শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সম্রাট, আরমান, খালেদ মাহমুদ, কৃষক লীগ নেতা কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা কাজী আনিসুর রহমান, যুবলীগের নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম ছাড়াও অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধানসহ অনেক রাঘব বোয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ও রুপন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান তখন ‘শুদ্ধি অভিযান’ হিসেবে পরিচিতি পায়। অভিযানের পর রাজধানীর ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, মতিঝিলের দিলকুশা ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবসহ বেশ কিছু ক্লাব বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সম্রাট ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আরমানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করা হয়। পরে সম্রাটের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং আইনে একটি করে মামলা করা হয়। কারাগারে প্রায় তিন বছর আটক থাকাকালে সম্রাট অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কাটান। গত বছর ২২ আগস্ট জামিনে মুক্ত হন। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক কর্মকর্তা বলছেন, সম্রাটের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। তার ব্যাপারে তথ্য চেয়ে ওই দুই দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখনও চিঠির জবাব না আসায় মামলার তদন্ত শেষ করা যায়নি। এদিকে ২০১৯ সালে অভিযান শুরুর পর সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক ওরফে ক্যাসিনো সাঈদ দেশ ছাড়েন। দীর্ঘদিন তিনি গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর চলতি বছরের শুরুর দিকে আবার প্রকাশ্যে আসেন।

২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে ওঠার পর সেখান থেকে নামিয়ে এনে সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক আরেকটি মামলা করে। তিন মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে সেলিম প্রধানের মামলায় অধিকতর তদন্ত করছে সিআইডি।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় ক্যাসিনো কারবার বন্ধ হলেও নানা কায়দায় জুয়ার আসর চলছে। কেউ কেউ দেশের বাইরে গিয়ে ক্যাসিনো খেলছেন। আবার দেশি-বিদেশি চক্র অনলাইনে অ্যাপ খুলে জুয়ার রমরমা কারবার চালাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে তা ১.৭% বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।

দেশে প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা অবৈধ। তবে এ আইন ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত। এতে সাজা খুবই কম। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তাঁর মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তবে জুয়া প্রতিরোধে নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, অনলাইনে জুয়াড়িদের নানামুখী তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু সাইট বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। কারণ এসব বেটিং অ্যাপ, ওয়েবসাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়।

আবার খুলছে ক্লাবপাড়া

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর বন্ধ থাকা ক্লাবগুলো চলতি মাসের শুরুতে খুলতে শুরু করেছে। কয়েকটি ক্লাবঘরের তালা খুলে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। ক্লাবগুলোর কমিটির নেতারা বলছেন, ক্লাব বন্ধ থাকলে দেশের ক্রীড়াঙ্গন ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হবে। তাই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে ক্লাব খুলে দেওয়ার বিষয়ে আবেদন করেন তারা। আইনগত বাধা না থাকলে খুলে দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় উচ্চ পর্যায় থেকে। তবে ক্যাসিনো, জুয়া না চালানোর জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর তাদের ক্লাব সিলগালা করা হয়নি। তালা মেরে রাখা হয়েছিল। আইনগত কোনো বাধা আছে কিনা, তা জানতে ঢাকা জজকোর্টেও আবেদন করা হয়েছিল। আদালত জানিয়েছেন, ক্লাবে তালা লাগানোর কোনো আদেশ নেই। এর পর ক্লাব খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

গতকাল রোববার দুপুরে মতিঝিলে ক্লাবপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের প্রধান ফটক খোলা। ক্লাব চত্বরে চেয়ারে ৮-১০ জন বসে আছেন। জানা যায় তারা ক্লাব কমিটির নেতা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী। কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি ও রংমিস্ত্রি কাজ করছেন। ভবনের দেয়ালে রঙের কাজ চলছিল। চলতি মাসের শুরুতে ক্লাবটির তালা খোলা হয়। অভিযানের পর ক্লাব তালাবদ্ধ থাকলেও ফুটবল লীগ চলমান ছিল।

ইয়ংমেনস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মাঈনু বলেন, দীর্ঘদিন ক্লাব বন্ধ থাকায় চোর চক্র তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে এসি থেকে শুরু করে সব আসবাব নিয়ে গেছে। এমনকি জানালার গ্রিল পর্যন্ত চুরি হয়েছে। শুধু ভবনের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। ভবনে নতুন করে কাজ শুরু করা হয়েছে। ক্যাসিনোর কারণে ক্লাবের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। ক্লাবে ক্যাসিনো, জুয়া চালাতে চাই না। ফুটবল নিয়েই থাকতে চাই।

ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের প্রধান ফটকে তালাবদ্ধ দেখা যায়। চার বছর ধরেই সেই তালা খোলা হয়নি। ক্লাব-সংলগ্ন খাবার হোটেলের মালিক মো. রিয়াদ জানান, অভিযানের পর থেকে ক্লাব বন্ধ। ক্লাবের নেতা কিংবা কর্মচারীরাও আসেন না।

ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন জানান, বন্ধের চার বছর পূর্তিতে সোমবার (আজ) ক্লাব খুলবেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু হবে জানিয়ে বলেন, যেসব অভিযোগে ক্লাব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেসব কার্যক্রম আর চলবে না। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, কাবাডি খেলা হয় তাদের ক্লাবে।

ক্লাব খোলার অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করা হয়। ক্লাবগুলো বন্ধ থাকলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ক্ষতি। এভাবে বন্ধ থাকলে শত বছরের ক্লাবগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্লাবের ভেতরে যে একশ বছরের ট্রফিগুলো ছিল, সেগুলো নেই। ক্লাবের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। ব্যক্তি খারাপ হতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান তো দোষ করেনি।

ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে তালা ঝুলতে দেখা যায়। দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের পাশের মুদি দোকানি জানান, অভিযানের পর থেকে ক্লাবটি বন্ধ ছিল। সপ্তাহখানেক আগে কর্তৃপক্ষ অফিস খুলেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। আজ সোমবার পুরোপুরি খোলার কথা বলে জানান তিনি।

আমারবাগ ক্রীড়া সংঘের নিচতলার প্রধান ফটক তালাবদ্ধ থাকলেও দোতলায় ক্রীড়া নিয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ক্রীড়া সংঘের ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন বলেন, ৩ সেপ্টেম্বর নিচতলার কক্ষগুলো খুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। তালা খুলে দেখা যায়, এসি ও সোফাসহ আসবাব চুরি হয়ে গেছে। সেগুলো নতুন করে কেনা হচ্ছে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মচারী মো. শরীফ জানান, ১ সেপ্টেম্বর ক্লাবের হলরুম খোলা হয়েছে। এখন থেকে আর ক্যাসিনো ও জুয়া খেলা হবে না।

ক্লাবপাড়ার বিভিন্ন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চার বছর আগে ক্লাবগুলো চালু থাকায় বিশেষ করে সন্ধ্যার পর ওই এলাকা সরগম থাকত। রাতভর নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে মানুষের যাতায়াত ছিল। অনেক সময় ক্যাসিনো কিংবা জুয়া খেলা নিয়ে ক্লাবের ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হতো। বাইরে এসেও অনেকে চিৎকার-চেচামেচি করতেন। কিন্তু ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এলাকার পরিবেশ একেবারে নিরিবিলি।

মতিঝিল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, অভিযানের সময় করা মামলার বিষয়ে বন্ধ ক্লাবগুলোর কর্তৃপক্ষ আদালতে রিট করেছিল। আদালত বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্লাব সিলগালা করেনি। তিনি আরও বলেন, ক্লাবে বৈধ ক্রীড়া কার্যক্রম চলতে কোনো আপত্তি নেই। ক্লাবের কমিটির নেতাদের বলা হয়েছে, ক্লাবের সদস্য ছাড়া ভেতরে কেউ ঢুকতে পারবে না। রাত ১১টার মধ্যে ক্লাব বন্ধ করতে হবে। ক্যাসিনো, জুয়া, হাউজিং খেলা যাবে না। এসব চালানো হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৫৬:৫৮ ● ১২১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ