পোশাক শিল্পে কালো মেঘ

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » পোশাক শিল্পে কালো মেঘ
সোমবার ● ৬ নভেম্বর ২০২৩


 ---

বঙ্গ -নিউজঃ  দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি আয়ের পণ্য তৈরী পোশাক শিল্পে কালো মেঘের ঘনঘটা। একদিকে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবির আন্দোলন; অন্যদিকে বিদেশে রফতানি অর্ডার কমে যাওয়া। এর মধ্যে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি। হরতাল-অবরোধে যোগাযোগ বন্ধ। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক ক্রয়ের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগেই জানিয়ে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক ধারা তথা নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর নির্ভর করবে আগামীতে ইউরোপের দেশগুলোয় বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের বাজারের ভবিষ্যৎ। যদি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন হয় তাহলে ইইউ জিএমপি প্লাস সুবিধা দেবে; না হলে ভিন্ন চিন্তা করবে। অন্যদিকে বেতন- ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টসগুলোতে শ্রমিক আন্দোলন চলছে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ ক্রয় অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। একদিকে শ্রমিক আন্দোলন চলছে; নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। হরতাল-অবরোধে যোগাযোগ বন্ধ থাকছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন তাতে ওই দেশগুলোর বাজার হারানোর আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য পোশাক শিল্প অশনি সংকেতের মুখে পড়তে যাচ্ছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরী পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক খুচরা পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্ডার দিয়েছিল, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য তার চেয়ে ২০ শতাংশ কম অর্ডার দিয়েছে। খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বিক্রি না হওয়া পণ্যের বড় আকারের মজুদ আছে। এ কারণে তারা নতুন অর্ডার দেওয়া থেকে বিরত থাকছে। তারা বিলম্বিত পেমেন্ট সুবিধা চাচ্ছে এবং রফতানিকারকদের অনুরোধ করছে চালান স্থগিত রাখতে। অর্ডারগুলো এমন এক সময় কমে এসেছে।

দেশের গার্মেন্টস পল্লীগুলোতে চলছে চরম অস্থিরতা। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের মধ্যেই বেশির ভাগ গার্মেন্টস খুললেও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবির আন্দোলন এবং ৩ শ্রমিক নিহত হওয়ার পর থেকে শ্রম অসন্তোষ বিরাজ করছে কারখানাগুলোতে। ইতোমধ্যে গাজীপুর-আশুলিয়ার ৫ শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। ওই এলাকার ৫০টির বেশি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটি দেয়া হয়েছে। মিরপুরে কয়েকটি কারাখানার শ্রমিকরা দাবি আদায়ের জন্য কয়েক দিন থেকে রাস্তায় আছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের ওপর হামলা-মামলা ও গ্রেফতারে পোশাক শিল্পে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম মাধ্যম তৈরী পোশাক খাত। রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি। তবে আগের তুলনায় রফতানি বাড়লেও বর্তমান বাস্তবতায় পোশাক শিল্পে নতুন করে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ও চীনভিত্তিক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বর্তমান দুর্বল বিশ্ব অর্থনীতি এবং আরেকটি ভবিষ্যৎ মন্দা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতে বিদ্যুৎ-গ্যাসের ঘাটতি এবং ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জ এ খাতকে বিপাকের মুখে ফেলেছে। শ্রমিক অসন্তোষে গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ায় এবং কারখানার কাজ বন্ধ থাকায় অনেক কাজের অর্ডার বাতিল হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সঠিক সময়ে অর্ডার প্রদান করতে না পারলে ভবিষ্যতের অর্ডার নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি এ খাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে হ্রাসকৃত পোশাকের চাহিদা এই শিল্পে সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করবে। এর ফলে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে অনেক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রফতানিকারক দেশ। দেশের মোট রফতানির ৮৪ দশমিক ৫ শতাংশই এই খাত থেকে হয়। দেশে ৪ হাজারেরও অধিক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ লোক জড়িত, যাদের অধিকাংশই নারী। তাই শিল্পের উন্নয়নে ও শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে ন্যায়সঙ্গত মজুরির পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যৎ কাজ বাড়ানো, সুন্দর কর্মপরিবেশ ও শারীরিক সুস্থতার ওপর জোর দেয়া উচিত। ইতোমধ্যে দেশে বিদ্যমান ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনকে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো সমর্থন জানিয়েছে।সূত্র মতে, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে এবং সার্বিকভাবে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ফলে পশ্চিমা ভোক্তারা তাদের ব্যক্তিগত খরচের ক্ষেত্রে আরো হিসেবী হয়ে উঠেছেন। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে ওয়ার্ক অর্ডারের সংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে অর্থনীতিতে প্রলম্বিত মন্দা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতের জন্য আরেকটি অশনি সংকেত। উল্লেখ্য, এ ২টি গন্তব্য থেকেই তৈরী পোশাক খাতের সিংহভাগ উপার্জন আসে।এক সমীক্ষায় বলা হয়, করোনা পোশাক খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। যার ফলে অনেক আন্তর্জাতিক আদেশ (অর্ডার) বাতিল হয়েছে। এতে আনুমানিক ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ২০২২ সালে এর প্রভাব কাটানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিল তা বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, এই খাতের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ধাক্কাগুলো সামাল দিতে হবে। এর পাশাপাশি এই শিল্পে গতিশীলতা ও দক্ষতা আনয়নে অটোমেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শ্রমিকদের কাজের সংস্থানের প্রভাবও বিবেচনায় আনা জরুরি।

এছাড়া সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেশে পরিবেশ সুরক্ষায় টেক্সটাইল বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতির দিকে মনোনিবেশ করা, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত মজুরি, বয়স্ক কর্মীদের অন্য পেশায় স্থানান্তর এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির স্বার্থে এই খাতের আর্থিক নীতিগুলো সহজীকরণ ও বাস্তবসম্মতকরণের সুপারিশ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আবদুস সামাদ আল আজাদ বলেন, আমাদের এখন থেকেই তুলাভিত্তিক পোশাক থেকে নির্মিত উপকরণগুলোর মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া হল দু’টি সম্ভাব্য অংশীদার যারা আমাদের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সহায়তা করতে পারে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত বছরের এপ্রিলে ‘বাংলাদেশ-জাপান শিল্প উন্নীতকরণ প্রকল্প’ নামে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছেন।’ তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ও এই অগ্রযাত্রায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ২০২৯ সাল পর্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক বাজার অ্যাক্সেসের সুবিধার একটি সম্প্রসারণ হতে চলেছে। এই সম্প্রসারণ নীতি-নির্ধারণকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য আরো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।এদিকে দেশে বিদ্যমান ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনকে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো সমর্থন জানিয়েছে। শ্রমিকদের ওপর পুলিশি লাঠিচার্জকে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি)-এর পক্ষ থেকে ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর সহিংস নিপীড়ন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়েছে অ্যাপারেল লেবার ইউনিয়ন অ্যালায়েন্স হিসেবে কাজ করা এই সংগঠনটি। সিসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ গার্মেন্টস মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) গার্মেন্টস সেক্টরে নতুন ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণে প্রস্তাব পেশ করেছে। কিন্তু এটি ট্রেড ইউনিয়নের দাবিকৃত বেতনের প্রায় অর্ধেক। সিসিসি মনে করে, চলতি বছরের মজুরি বৃদ্ধিতে চলমান আন্দোলনে দমন-পীড়ন ‘অভূতপূর্ব পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। যার ধারাবাহিকতায় একাধিক গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়েছে। সিসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো কোড অব কন্ডাক্ট এবং স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মজুরি নির্ধারণ কাঠামোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবন্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকদের যে দাবি, সেটিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্র্যান্ডগুলো ব্যর্থ হয়েছে। ন্যূনতম মজুরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে হওয়া সহিংসতার নিন্দা জানাতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা সকল পোশাক ব্র্যান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিসিসি। একই সাথে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণে শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতি প্রদান, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের দাবি মজুরি বোর্ডের কাছে তুলে ধরা এবং শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষিত করতে ব্র্যান্ডগুলোকে সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া স্পোর্টস জায়ান্ট ব্র্যান্ড এডিডাস, মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ড লেভি স্ট্রাউস অ্যান্ড কো-এর পক্ষ থেকে গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যৌথভাবে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে এমন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে অনুরোধ করা হয়।

বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শিল্পের বর্জ্যরে জন্য মাত্র ২/৩টি রিসাইক্লিং সেন্টার রয়েছে। আমরা যদি পুনর্ব্যবহৃত সুতা রফতানি করি তাহলে তা ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পরিবেশ সুরক্ষা বিবেচনায় আমাদের ফাইবার বৈচিত্রকরণ সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। উল্লেখ্য, বিগত ছয় বছরে লাইটক্যাসল প্রতিষ্ঠান এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করে। যাতে দেশে এ খাতে চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১০:১৪:১৮ ● ১০৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ