রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে সিলেট এলেন

Home Page » English News » রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে সিলেট এলেন
বুধবার ● ১৫ নভেম্বর ২০২৩


ছবি সংগৃহীত

ডেস্ক রিপোর্টঃ ১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবকাশ যাপনের জন্য আসামের তৎকালীন রাজধানী শৈলশহর শিলং এলেন। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। শিলংয়ের পার্শ্ববর্তী শহর সিলেটে এই খবর চাউর হয়ে গেলো দ্রুততম সময়ে।

সিলেটের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে একটা চাপা উত্তেজনা বইতে শুরু করলো। কবিগুরু এতো কাছে এসেছেন, কোনভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। যেভাবে হোক রবি ঠাকুরকে সিলেটে আনতেই হবে। সিলেট ব্রাক্ষসমাজের তৎকালীন সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ন সিংহ কবিকে সিলেট পদার্পণের নিমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন। কিন্তু বাধ সাধলো তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভৌগলিক দিক দিয়ে সিলেট শিলং-এর কাছাকাছি হলেও সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিলো না। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত সড়ক ছিল। চেরাপুঞ্জি থেকে খাসিয়ারা ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার একটি পদ্ধতি প্রচলন ছিলো। কিন্তু এ ব্যবস্থা মানবাধিকারের লংঘন বলে কবি সরাসরি নাকচ করেন এবং সিলেট থেকে প্রেরিত নিমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কবির নেতিবাচক উত্তর পেয়ে গোবিন্দ নারায়ন সিংহ আনজুমানে ইসলাম, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংঘটনের সাথে যোগাযোগ করে কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠান।

আবেগঘন টেলিগ্রামগুলো কবির হৃদয়কে প্রভাবিত করে। তিনি সিলেট আসার দীর্ঘ অথচ বিকল্প পথ গৌহাটী থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌঁছানোর পথে সিলেট আসতে রাজি হন। ৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটী অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। দিন তিনেক সেখানে অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। গৌহাটী থেকে সিলেটের পথ প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়। ট্রেন কুলাঊড়া জংশনে পৌঁছালে তাঁকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তাঁর সহযাত্রীরা কুলাঊড়াতে রাত্রিযাপন করেন। কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য অভ্যর্থন পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি নিযুক্ত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ। ৫ নভেম্বর সকালে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে কবিগুরুকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, মৌলভী আব্দুল করিম, রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত, এহিয়া ভিলা, কাজী বাড়ি ও মজুমদার বাড়ী, দস্তিদার বাড়ির অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। সিলেট মহিলা সমাজের পক্ষে অভ্যর্থনা জানান নলিনীবালা চৌধুরী। সুরমা নদীর উপর ঐতিহ্যবাহী ক্বিনব্রিজ তখনো হয়নি। কবিগুরু ও তাঁর সহসঙ্গীরা বজরায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে মূল সিলেট শহরে প্রবেশ করেন।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটকে পত্র-পুষ্প পতাকা, মঙ্গল ঘট আর লাল শালু দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি মৌলভী আব্দুল করিমকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি সুসজ্জিত ফিটন গাড়িতে করে শহরের উত্তর-পূর্বাংশে ছোট টিলার উপর পাদ্রী টমাস সাহেবের বাংলোর পাশে একটি বাড়িতে যান। এখানেই কবির থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেখানে পৌঁছালে কবিকে সঙ্গীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্রাহ্মসমাজের আমন্ত্রণে কবি তাদের উপাসনায় যোগ দেন। পরদিন ৬ নভেম্বর সকালে লোকনাথ টাউনহলে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ আব্দুল মজিদ। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন নগেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনন্দন-এর জবাবে বক্তৃতা প্রদান করেন যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। একইদিন দুপুরে মুরারীচাঁদ কলেজের (এম.সি কলেজ) বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে কবি তাঁর বাড়িতে যান। বেলা দুই ঘটিকায় ব্রাহ্মসমাজগৃহে সিলেট মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন। এরপর কবি শহরের উপকন্ঠে মাছিমপুর এলাকায় মনিপুরী পল্লীতে যান। কবির সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী রমনী কর্তৃক পরিবেশিত রাসনৃত্যে মুগ্ধ হন। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিগুরু পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্য চালু করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালে কবিগুরু তৎকালীন সিলেট জেলার কমলগঞ্জ থানার বালিগাঁও গ্রামের মণিপুরী নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জী, ত্রিপুরা থেকে গুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহ ও আসামের গুরু সেনারিক সিংহ রাজকুমারকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান প্রশিক্ষক হিসেবে। পরদিন ৭ নভেম্বর সকালে সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টার বিখ্যাত সিংহ পরিবারের এক নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে কবি যোগদান করেন। এদিন দুপুরে মুরারিচাঁদ ছাত্রাবাসে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকমন্ডলী কবিগুরুকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। কলেজের ছাত্ররা একটি শোভাযাত্রা করে গীতবাদ্য সহকারে সভামন্ডপে নিয়ে আসেন। অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রী সরচিত কবিতা পাঠ করেন। কবিকে একাধিক মানপত্র প্রদান করা হয়। অভিনন্দনের উত্তরে কবি সুদীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন। পরবর্তীতে এই বক্তব্য শান্তিনিকেতন পত্রিকার ১৩২৬ সালের পৌষ সংখ্যায় ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে প্রকাশিত হয়।

এম.সি কলেজের সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে পরবর্তীকালের একজন বিখ্যাত বহুভাষী রমসাহিত্যিক তন্ময় হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য শুনছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গুণমুগ্ধ সেই ভক্তকে শান্তিনিকেতনে আসার কথা বলেন। ১৯২১ সালে সেই ছাত্র শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন এবং রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন। তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। সভাশেষে এম.সি কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের আতিথ্যগ্রহণ করে তাঁর বাসায় পদার্পন করেন। পরে শহরের গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে রায়বাহাদুর নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাসায় এক প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন। পরদিন ৮ নভেম্বর কবিগুরু সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করেন। আর বিমুগ্ধ নয়নে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকেন তাঁর গুণমুগ্ধরা।

বাংলাদেশ সময়: ১:৩৭:১৪ ● ৩৮৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ