গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার- স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার- স্বপন চক্রবর্তী
রবিবার ● ১০ মার্চ ২০২৪


ঢেঁকিতে হলুদ কোটা হচ্ছে

আমার শ্যালকের ছোট ছেলের পৈতা বা উপনয়ন দেওয়া হবে। পৈতা হলো ব্রাহ্মণ পরিবারের একটি সংস্কার কাজ। এটা ছেলে সন্তানের জন্য। এই সংস্কার কাজের মাধ্যমে সাধারণ থেকে দ্বিজ রূপে উন্নীত হয় সন্তান ( জন্ম নঃ যায়তে শুদ্র, সংস্কারচঃ দ্বিজোচ্চতে, বেদভ্যাস পঠেৎ বিপ্রঃ ব্রহ্মজ্ঞানাতি ব্রাহ্মণ) ।  পরে বেদভ্যাস করে এবং ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে ব্রাহ্মণ হিসাবে উন্নীত হয়,। উপনয়ন হলো অতিরিক্ত আর একটি নয়ন বা চক্ষু।  এটা দিয়ে সন্তানকে বিদ্যা লাভ, ধ্যান বা শাস্ত্রীয় জ্ঞান লাভের জন্য পথ নির্দেশিকা দেন দীক্ষাগুরু। আগে ছিল টোল ব্যবস্থা। সেখানে সংস্কৃত বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করার জন্য পাঠ দিতেন গুরু বা পন্ডিত মশাই। ধর্মীয় ভাবে এমন  কথারেই উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই তো এই অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ পরিবারগুলো যত্নের সাথে পালন করে থাকেন। এটা অবশ্য অন্যান্য কিছু হিন্দুদের মধ্যেও চালু আছে, যেমন উত্তর বঙ্গের ক্ষত্রিয় ও দেবনাথ সহ আরও কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে পৈতা নেয়ার প্রচলন দেখেছি। তবে ব্রাহ্মণদের পদ্ধতিতে নয়। এখন অবশ্য টোল শিক্ষা ব্যবস্থা আর নেই। পৈতা  সম্পর্কে লালন বলেছেন, “ বামুন চিনি পৈতা প্রমাণ, বামুনী চিনি কিসে রে” । পৈতা হলো ব্রাহ্মণের পরিচয়, পৈতা হলো একটি সংস্কার কাজ। এই সংস্কার কার্যকে ”নগুণ”বা নবগুণ নামেও উল্লেখ করা হয়। নয়টি গুণের আধার এই সংস্কার কাজ। তাই এরূপ বলা হয়। প্রসঙ্গত সংক্ষেপে ৯টি গুণের উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক ভাবে চলে এসেছে। তাই পৈতা নিয়ে বিশদ লিখার ইচ্ছে না থাকলেও প্রসঙ্গ আমাকে সামান্য লিখতে বাধ্য করছে।

পৈতা ,উপনয়ন ,যজ্ঞোপবীত, নগুণ, নবগুণ বা লগুণ নামেও এই সংস্কার কাজটি পরিচিত।
পৈতার মধ্যে ৯টি সূতা থাকে। প্রতি তিন সূতা দিয়ে একটি করে মোট  ৩টি গিঁট  দ্বারা পৈতা তৈরী হয়। মোট সূত্রসংখ্যা হয় ৯টি। তারও আবার প্রতিটি সূতাতে থাকে তিনটি সূক্ষ সূতা। তাই মোট সূতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৯/৯ =৮১টি। এটা বিশেষ পদ্ধতিতে কার্পাস তুলার সূতা দিয়ে তৈরী হয়। তাই নবগুণ বা অপভ্রংশ হিসাবে লগুণও অঞ্চল ভেদে বলা হয়ে থাকে। ৯টি সূতা ব্রাহ্মণের ৯টি গুণের পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। যেমন-
১) সম গুণ:- সমান অর্থাৎ সমমানে সমান। কে নিচ কে শুচি, কে মুচি সবাই ব্রাহ্মনের কাছে সমান। উল্লেখ্য যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে এর বিপরীত চরিত্রই পরিলক্ষিত হয়। এ নিয়ে অনেক অপবাদও সহ্য করতে হয়।
২) দম:- দম মানে দমন করে রাখা। দেহের সমস্ত ইন্দ্রকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ বা দমন করে রাখতে হবে।
৩) তপ:- তপস্যা করা। ব্রাহ্মণ সর্বদা সৎ মনোভাবে তপস্যা করবে।
৪) শৌচ:- মন এবং দেহকে সবসময় শুচি বা পবিত্র রাখতে হবে।
৫) ক্ষান্তি:-ক্ষমা করার মানসিকতা। যে যা অপরাধ করুক , ব্রাহ্মণের চোখে সেটা অপরাধ হবে না, বরং সবাইকে ক্ষমা করার ক্ষমতা রাখতে হবে।
৬) আর্যভাব:- মানে সরল ভাব। সবসময় শিশুর মতো সরলতা থাকতে হবে।
৭) জ্ঞানাং:- অথাৎ জ্ঞান লাভ করতে হবে। তার মানে জ্ঞানের উপর আরও জ্ঞানের অধিকারী তথা চৈতন্য জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
৮) বিজ্ঞানম:- সর্ব শ্রেষ্ঠ জ্ঞান বা ভগবতের জ্ঞান অন্তরে থাকতে হবে।
৯) আস্তিক্য:- অর্থাৎ ধর্মের প্রতি পূর্ণ আস্থা বা বিশ্বাস থাকতে হবে।
তবে মতান্তরে যজ্ঞোপবীত বা পৈতা বা প্রতিজ্ঞাসূত্র অথবা ব্রতসূত্রের তিন নাল সম্বলিত তিনটি গিট বা গ্রন্থিকে সরস্বতী,গায়ত্রী ও সাবিত্রীর প্রতীক বলেও গণ্য করা হয়। আবার তিনটি গিঁটকে তিনটি দায় বা ঋণের প্রতীকও বলা হয়। যেমন- দেবঋণ, পিতৃঋণ ও ঋষি বা ‍গুরুঋণ। এসব ঋণ স্বীকার এবং কৃতজ্ঞ থাকার প্রতি প্রতিজ্ঞাও থাকতে হয়।
সাধারণত ১০/১২ বছরের মধ্যে পৈতা দেওয়াই উত্তম। তখন থেকে প্রতিদিন একনিষ্ঠ ভাবে ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক ও গায়ত্রীজপ সহ অন্যান্য বৈদিক কাজ কর্ম বাধ্যতামূলক শুরু হয়ে যায়। শারীরিক শুচিতা, মিথ্যা না বলা, স্নানাহারের সময় মৌনতা পালনসহ অনেক কার্যাদিও শুরু হয়। তাই পৈতা দেওয়ার কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করা অভিভাবকদের একটা দায়। সাধ্যমতো জাঁকজমক করা ,অতিথি আপ্যায়ন, ব্রাহ্মণ ভোজন ও দানদক্ষিণা প্রদান করা  প্রশস্ত হয়। উপনয়ন প্রদানের আগে তথা মাঙ্গলিক কাজের অব্যবহিত আগে গায়ে হলুদ দেওয়া প্রচলিত একটি অনুসঙ্গ। শুভ বিবাহ ও শুভ অন্নপ্রাশন তথা যাবতীয় শুভ কাজের সূচনাকালে গায়ে হলুদ দেওয়া একটা প্রথা। এটা স্থান কাল ও সামর্থ ভেদে ভিন্নও হয় বা প্রতীকিও করেন অনেকে। যাদের সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় রয়েছে তাদের এটা না করলে নয়। সে গায়ে হলুদের জন্য ” এয়ো “ ( বিবাহিতা  সধবা মহিলা ) লাগে ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনের জন্য। নিজের পরিবারে এমন সংখ্যা কম হলে নিমন্ত্রণ জানিয়ে এয়োগণকে নিয়ে আসা হয়। তাঁরা গায়ে হলুদ দেন এবং স্নান করান। এতে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, বাদ্যবাজনা ও মহিলাদের গীত গাওয়ারও প্রচলন আছে।
আমার আত্মীয় তনয় “ অনিকে” উপনয়ন প্রদানের সময় আমাদেরকেও থাকতে হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শুরুতে হলুদ কুটার কাজ। সেটা আবার নিজ হাতে ঢেঁকিতে তৈরী হলুদ প্রয়োজন। অভিভাবকগণ কোন আপোষ করতে রাজি ছিলেন না। তাই ঢেঁকি খুঁজতে শুরু করলেন। নিজেদের নাই, তাই খুঁজতে হচ্ছে অন্যত্র। এই ঢেঁকি যখন এতো অত্যাবশ্যকীয়, তখন ঢেঁকি পাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। কারণ এটা বিলুপ্তপ্রায়। যদিও এক সময় এর যথেষ্ঠ কদর ছিল। একটু অবস্থাসম্পন্ন পরিবার হলেই ঢেঁকি একটা থাকতো। থাকতো ঢেঁকি ঘর। পাড়ার অন্যান্য পরিবারের মহিলা সদস্যগনও এসে নিজেদের ধান,গম এবং চাল থেকে গুঁড়ো বা চালের আটা তৈরী করতেন। আধুনিক সভ্যতা ও বৈদ্যতিক যুগে পূর্ণ প্রবেশের কারনে সেই সনাতনী পদ্ধতির ঢেঁকি এখন আর পাওয়া যায় না। সব দৃশ্যপট পাল্টে গেছে । কিন্তু গায়ে হলুদের ধারাবাহিকতা আর বিধিবিধান তো পাল্টে যায়নি। তাও আবার পরিবারের ছোট ছেলের অনুষ্ঠান। সাধ্যমতো ত্রুটিহীন করার একটা বাসনা। তাই খুঁজে খুঁজে বের করা হলো এই অপরিহার্য ও একদা সময়ের অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ ঢেঁকি। একটি কলোনীর মধ্যে জরাজীর্ণ একটা ঢেঁকি পাওয়া গেলো। এটা দেখে মনে হলো যে, এর অনেক কিছু নেই। হারিয়েছে যৌলুস, হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। বিবর্ণ জরাগ্রস্থ ভগ্নহৃদয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। কোন রকমে টিকে থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে মাত্র। । অবজ্ঞা অবহেলায় বাড়ির এক কোনে পড়ে থেকে তার অস্থিত্ব টিকিয়ে রেখেছে । কাজি নজরুলের বর্ণনা এখানে একটু উদ্ধৃত করতে চাই, কারণ আমার পক্ষে এর দৈন্যদশার বর্ণনা যথেষ্ঠ হবে না। নজরুল একজন ভিক্ষুকের শারীরিক চিত্র বর্ণনাকরতে গিয়ে বলেছেন “ জীর্ণ বস্ত্র-শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ, ডাকিল পান্থ, “ দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো অনেক ( সাত) দিন”।
মানুষ যদি হীন অবস্থায় পতিত হয়, তখন তার ঐতিহ্য নিয়ে আলাপ করতে ও মনে করতে ভালোবাসে। ঐতিহ্য হলো গৌরবময় অতীত। আবার আগের দিনহীন কষ্টের তুলনায় বর্তমান অবস্থা যদি বেশি সুখের হয়, তাহলে অতীতের দুঃখের দিনগুলোকে স্মরণ করতে চায় না। উত্থাপনও করতে চায় না। তাই ঢেঁকিটিও হয়তো ভাবতেছিল যে, আগের দিনটা আর নাই রে। আমরাও ফেসবুক প্রোফাইলে অতীতের তুলনা মূলক আকর্ষণীয় ছবিই পোস্ট দিতে বেশি ভালোবাসি, যদি না বর্তমান বার্দ্ধক্যে পৌঁছে থাকে। ( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ১৭:১১:৫৯ ● ৭৪০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ