শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা সুশাসনের অভাবে

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা সুশাসনের অভাবে
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪


ফাইল ছবি
 বঙ্গনিউজঃ   কীভাবে চলতি দর পতন বন্ধ করে শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী করা যাবে এবং কীভাবে বিনিয়োগকারীদের আবার ফিরিয়ে আনা যাবে– এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শেয়ারবাজারের প্রধান অংশীজনকে ডেকে গতকাল বৈঠক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে অংশীজন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, দর পতন রুখতে সহজ কোনো সমাধান তাদের জানা নেই।

টানা দুই মাসের অধিক সময় দর পতন চলার প্রেক্ষাপটে তা ঠেকানোর কোনো উপায় না পেয়ে সোমবার শীর্ষ অংশীজনকে ডেকে পাঠিয়েছিল বিএসইসি। বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই জানিয়েছেন, খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। তবে কার্যত ফল শূন্য। তারা  জানান, তারল্য সংকট এ বাজারের প্রধান সমস্যা। তবে কীভাবে তারল্য আসবে, সে বিষয়ে ভালো সমাধান কেউ দিতে পারেননি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বরাবরের মতো ব্রোকার ডিলার, বিভিন্ন ব্যাংক এবং মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

অন্যদের মধ্যে বৈঠকে ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএ সভাপতি মাজেদা খাতুন এবং ইউসিবি, সিটি, ইস্টার্ন, লংকাবাংলা, আইডিএলসি, শেলটেক, শান্তাসহ কয়েকটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম তারিকুজ্জামান এবং প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদকেও ডাকা হয়েছিল। তবে তারা বক্তব্য দেননি; তাদের কিছু বলতেও বলা হয়নি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিএসইসির কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে বিএসইসির কমিশনার জানতে চান– দরপতন কেন হচ্ছে এবং কীভাবে দরপতন বন্ধ করা যাবে। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডিবিএ নেতারা স্পষ্ট করে বলেন, একক কোনো কারণ দিয়ে দর পতনকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ বাজারে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ আসছে না, বরং লোকসান দিয়ে হলেও অনেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতৃবৃন্দ বলেন, বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে ভালো কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠছে। শেয়ারবাজারে কারসাজি হচ্ছে এবং দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কারসাজি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি কোম্পানিগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো শেয়ার হিসেবে বিবেচিত হলেও গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি সরকারি কোম্পানিতে সরকারের ঋণকে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই শেয়ারে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে এসব কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় কমেছে। সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগকারীরা এ বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন এবং তারা বাজার ছাড়ছেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক অংশীজন বলেন, যথেচ্ছ মার্জিন ঋণও শেয়ারবাজারে বড় সংকট তৈরি করছে। শেয়ারবাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন মার্জিন ঋণ ওই ঊর্ধ্বমুখী ধারাকে যতটা বাড়িয়ে দেয়, পতনের সময় এর বিরূপ প্রভাব ফেলে আরও বেশি। দর পতনের সময় মার্জিন ঋণে শেয়ার কেনা বিনিয়োগকারীরা ‘ফোর্স সেল’-এ পড়ে বিনিয়োগের পুরোটাই হারিয়ে ফেলেন। বহু বছর ধরে মার্জিন ঋণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অংশীজনরা বলেন, বর্তমান কমিশনের চার বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। দীর্ঘ এই চার বছরে এ কমিশন এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, যার কারণে বিনিয়োগকারীরা এ বাজারে বিনিয়োগে আস্থা পান। উল্টো অনেকে মনে করেন, তাদের বাজারের ভবিষ্যৎ বিষয়ে উচ্চাশা দিয়ে ডেকে এনে প্রতারণা করা হয়েছে।

ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা বলেন, এখন এমন এক পরিস্থিতি হয়েছে, অনেক বিনিয়োগকারী লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যেতে পারলেও ব্রোকারেজ হাউসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা বন্ধ করে চলে যেতে পারছে না। শেয়ারবাজারের লেনদেন ক্রমে কমতে থাকায় সব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা হারিয়েছে। কোনোভাবে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে নিজের বিনিয়োগ করা শেয়ার বিক্রি করে কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা।

শেয়ারবাজারের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব ছাড়াও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থ বাজারের সংকটও চলমান শেয়ারবাজার সংকটকে আরও গভীর করছে বলে মত দেন বৈঠকে অংশ নেওয়া শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং এর পরই একবারে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয় করতে গিয়ে দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাবস্থা তৈরি হয়েছে। বিশেষত ক্রমবর্ধমান ব্যাংক সুদের হার বাজারে তারল্য সংকট ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিএসইসির পক্ষ থেকে সমাধানের পথ কী জানতে চাইলে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, চলতি সংকটের রাতারাতি সমাধান নেই। বললেই কেউ বিনিয়োগ নিয়ে আসবে না। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি আনতে হবে এবং শেয়ারবাজারে কারসাজি প্রতিরোধে কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এমন আস্থা পাবেন যে, কেউ কারসাজি বা প্রতারণা করে তাদের টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে না।
অংশীজনদের এমন অভিমতের পর বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত ব্রোকার ডিলারদের বিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানান বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, দর পতন রুখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও অনেক ব্যাংক এখনও তা নেয়নি। আবার কোনো কোনো ব্যাংক আংশিক সুবিধা নিলেও পুরোপুরি বিনিয়োগ করেনি। এসব ব্যাংককে প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিয়ে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবস্থাপনাধীন মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাজার পরিস্থিতি
সোমবার বিকেলে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের খবর গত রোববারই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। গতকাল লেনদেনের শুরুতে এর ইতিবাচক প্রভাব ছিল শেয়ারবাজারে। শুরুতে প্রায় ৩০০ শেয়ারের দর বাড়লেও শেষ পর্যন্ত ২২১ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দরবৃদ্ধি দিয়ে দিনের লেনদেন শেষ হয়। এ ছাড়া শুরুতে প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৪৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৭০২ পয়েন্ট ছাড়ালেও শেষ পর্যন্ত ২১ পয়েন্ট বেড়ে ৫৬৭৪ পয়েন্টে থামে। তবে শেয়ার লেনদেন প্রায় ৯৭ কোটি টাকা বেড়ে প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ৮:২৫:৪৮ ● ৪৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ