গাজার পথে প্রবল বাধা

Home Page » জাতীয় » গাজার পথে প্রবল বাধা
শুক্রবার ● ৩ অক্টোবর ২০২৫


গাজার পথে প্রবল বাধা

গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে মানবিক সহায়তা নিয়ে যাওয়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার জাহাজ বহরকে বাধা দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার উপকূলীয় জলসীমায় ভূমধ্যসাগরে আটক করা ফ্লোটিলার জাহাজগুলোকে গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যায় তারা- এএফপি

অবরুদ্ধ গাজার মানুষের কাছে খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি সহায়তা পৌঁছে দিতে যাত্রা শুরু করেছিল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। মানবিক সহায়তা বহনকারী এই প্রতীকী অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী মানুষ ও মানবাধিকার কর্মীরা। সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ শত শত কর্মীকে আটকের মাধ্যমে গাজা অভিমুখে যাওয়া ত্রাণবাহী ফ্লোটিলার যাত্রা নস্যাৎ করে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। বহরের জাহাজগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে এবং ৪৪৩ কর্মীকে আটক করেছে তারা। গন্তব্যে না পৌঁছালেও ফ্লোটিলা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে, নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিবেককেও।

মানবিক এই উদ্যোগ আটকে দেওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, জার্মানি, তিউনিসিয়া ও তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। পাকিস্তান, বলিভিয়া ও মালয়েশিয়া থেকেও ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা উঠেছে। ইতালিতে কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, আটক কর্মীদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটাই প্রধান অগ্রাধিকার। মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, আমরা আশা করি তাদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ এবং তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা হবে। গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছানো বাধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক ইসরায়েলকে জরুরিভাবে গাজার অবরোধ তুলে নিয়ে জীবন রক্ষাকারী উপকরণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা নৌকায় থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সংকট সমাধানের আশায় তারা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ ইসরায়েলের নৌ অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করতে রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃত গণহত্যা ও বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারে রাখা অব্যাহত রেখেছে। হামাস ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়েছে।

ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গাজায় ত্রাণবাহী ফ্লোটিলার ওপর ইসরায়েলের ‘আক্রমণ ও আগ্রাসনের’ নিন্দা জানিয়েছে। তারা জানায়, ইসরায়েলের দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক বিচার আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে। সুতরাং, ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক জলসীমার ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব নেই।

ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাবেক নেতা এবং বর্তমানে ইয়োর পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন। আর নৌবহরে বাধা দেওয়া ও কয়েকজনকে আটক করাকে অপহরণ আখ্যা দিয়েছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কর্তৃপক্ষ।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউম বলেন, তারা কোনো অপরাধ করেননি এবং অবিলম্বে তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় ফ্লোটিলাকে বাধাদান আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। এর মাধ্যমে বহরটিতে থাকা কয়েক ডজন দেশের পতাকার সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলের পদক্ষেপকে সন্ত্রাসবাদী কাজ বলে নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলকে জবাবদিহি করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো দেশটি থেকে সব ইসরায়েলি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছেন এবং নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ তুলেছেন। নৌবহরে কলম্বিয়ার দুই নাগরিক ছিলেন। দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গে করা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও বাতিল করেছে।

তবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি গাজায় ফ্লোটিলার সমালোচনা করে বলেছেন, এসব কাজ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না। জার্মানি ফ্লোটিলার আটক কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়েছে। ফ্লোটিলায় আটকের ঘটনায় ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে বেলজিয়াম। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্সিম প্রিভোট ইসরায়েলের পদক্ষেপকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। অস্ট্রেলিয়া সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে, জড়িতদের নিরাপত্তা এবং মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী মালয়েশিয়ার ২৩ জন নাগরিককে আটক করেছে। এক ভিডিও বার্তায় তিনি মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মিত্রদের সমর্থন কামনা করেছেন। শান্তিপূর্ণ ত্রাণবহরে ইসরায়েলের বাধাদানের নিন্দা জানিয়েছে ব্রাজিল। গাজাগামী নৌবহর আটকের পর ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে স্পেন।

ইসরায়েল জানিয়েছে, নৌবহরের কর্মীদের ইউরোপে নির্বাসিত করা হবে। আটকের আগে থুনবার্গ এক ভিডিওতে জানান, ইসরায়েলি বাহিনী আমাকে অপহরণ করেছে এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে গেছে।

যা বললেন গ্রেটা থুনবার্গ ও ম্যান্ডেলা
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফ্লোটিলার কর্মীদের আটকের ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে গ্রেটা থুনবার্গ একটি জাহাজের ডেকে বসে আছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক সদস্য তাঁকে পানি ও জ্যাকেট দিচ্ছে। আটকের পর কর্মীদের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

এর আগে রেকর্ড করা এক ভিডিওতে থুনবার্গ বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনী আমাকে অপহরণ করেছে এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে গেছে। আমাদের মানবিক মিশন ছিল অহিংস এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করা হয়েছে। দয়া করে আমার সরকারকে বলুন আমার এবং অন্যদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করতে।’

ফ্লোটিলায় ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি জুয়েলেভেলিল ম্যান্ডেলা। তিনি এক ভিডিওতে বলেন, ‘আমার নাম নকোসি জুয়েলেভেলিল ম্যান্ডেলা, আমি দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। আপনি যদি এই ভিডিওটি পান, তাহলে এর অর্থ হলো বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল আমাদের আটকে দিয়েছে এবং অপহরণ করেছে।’

১৬ বছর পর নৌ অবরোধ ভাঙলো ফ্লোটিলার জাহাজ
এদিকে, ফ্লোটিলার একটি জাহাজ ১৬ বছর পর এই প্রথম ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভাঙতে সক্ষম হলো। জাহাজটি ফিলিস্তিনি জলসীমায় ঢুকে পড়ে এবং গাজার উপকূলের কাছাকাছি যায় বলে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান। জাহাজটির নাম মিকেনো। দখলদার দেশটি ২০০৯ সাল থেকে গাজার জলসীমায় নৌ অবরোধ দিয়ে রেখেছে। অবরোধের পর এই প্রথম কোনো নৌবহর গাজার ৭০ নটিক্যাল মাইল (১২৯ কিলোমিটার) কাছাকাছি যেতে পারল।

গতকাল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বহরে হানা দিয়ে কর্মী ও নৌযানগুলো আটক করে ইসরায়েল। এ সময় মিকেনো জাহাজটি তাদের হাত থেকে পালিয়ে বহুদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
বিবিসি জানায়, ফ্লোটিলায় ৪৪টি দেশের ৪৯৭ যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক রয়েছেন। আয়োজকদের মতে, তাদের মধ্যে ২৪ জন মার্কিন নাগরিকসহ কয়েকজন সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিও আছেন। শুরুতে এই বহরে ছিল ৫০টির বেশি জাহাজ। ইসরায়েলের হামলায় তা কমে দাঁড়ায় ৪৪টিতে।

ঘটনার পরই ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ফ্লোটিলা থেকে একটি ছাড়া বাকি সব ক’টি জাহাজ আটক করেছে। আটক কর্মীদের ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ফ্লোটিলা যেভাবে থামিয়ে দেওয়া হলো
গাজার জনগণের কাছে খাদ্য, পানি ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ৪৪ দেশের ৪৯৭ জন অংশগ্রহণকারী বহরটি নিয়ে স্পেন-ইতালির বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ইসরায়েল আগে থেকেই ঘোষণা দেয়, ফ্লোটিলা গাজায় আসুক, তারা তা চায় না।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার ভোরে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর সদস্যরা বহরের কাছে এসে একটি জাহাজ আটকে দেয়। এরপর তারা সেই নৌকাটিতে উঠে পড়ে। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলি বাহিনী বহরটিতে বাধা দেয়। এই বাধাদানকে ফ্লোটিলার কর্মীরা মানবতাবাদীদের ওপর আক্রমণ হিসেবে উল্লেখ করে।
ফ্লোটিলার ট্র্যাকার অনুসারে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফ্লোটিলার ৪৪টি জাহাজের মধ্যে মাত্র চারটি তখনও চলাচল করছিল। বাকিগুলো হয় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে অথবা আটকে রাখা হয়েছিল। পরে ইসরায়েল ঘোষণা করে, তারা গাজায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা একটি জাহাজ ছাড়া বাকি সব জাহাজকে আটকে দিয়েছে। তারা জানায়, ফ্লোটিলার কোনো জাহাজকেই সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

পরে ফ্লোটিলার কর্মীরা জানান, একটি জাহাজ ছাড়া সব ক’টি জাহাজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জাহাজটি ছিল পোল্যান্ডের পতাকাবাহী। ইসরায়েলি দখলদার নৌবাহিনী ফ্লোটিলার আটক করা জাহাজগুলোকে নিয়ে যায় ও কর্মীদের অপহরণ করে। সর্বশেষ আশদোদ বন্দরে আটক করা তিনটি জাহাজকে দেখা গেছে বলে জানায় আলজাজিরা

বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৬:৩৪ ● ২৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ