
ব্যাংকের চাকুরিতে কোন সময়ে সহজে ছুটি ভোগ করা যায় না। ছুটির আবেদন করলে সেই আবেদন ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠাতে হয়। তারপর দয়াপরবশ হয়ে কর্তৃপক্ষ ছুটি মঞ্জর করেন এবং অন্য একজন রিলিভার আসলে তবেই ছুটি ভোগ করা যায়। আমাদের গ্রুপের দু’একজন নিজেদের বিবাহ সম্পর্কে ছুটি না পাওয়া নিয়ে লিখেছেন। একদিন মাত্র ছুটি নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে এসেছেন, নতুবা অর্ধ দিবস ছুটি নিয়ে গিয়ে বিয়ে সেরে এসেছেন। চাবিধারি যারা তাদের বিপত্তি আরও বেশি। এসব নিয়েও লেখক জনাব জালাল উদ্দিন মাহমুদ সুন্দর করে তাঁর বই “ রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন” গ্রন্থে লিখেছেন। অনেক সময়ে ছুটি পেলেও ছুটিতে যাবার মানসিকতা থাকে না। দায়িত্ব সায় দেয় না। অর্থাৎ কাজ গুছিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যাংকের চাকুরি শেষ করে নিরাপদে অবসরে যাওয়াটাও একটা কঠিন অগ্নি পরীক্ষা। অনেকেই সাসপেন্ড হন, অনেকের অবসরোত্তর প্রাপ্য আটকে যায়। অনেকে হয়তো প্রাপ্যের আংশিক পান, আর বাকিটুকু আংশিক দন্ড হিসেবে কেটে রাখা হয়। না, তবে সব ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সততার অভাব যে, দায়ী তা নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অসৎ লোকের কুটকৌশলের কাছে অনেকে পরাস্ত হয়ে যান। আপনি ভালো ড্রাইভার,খুব সাবধানে গাড়ি চালান। কিন্তু অন্য একজন এসেও আপনার গাড়িতে আঘাত দিতে পারে। তাতেও পরিণতি খারাপ হতে পারে। ঋণ বিতরণ করতে হয়। আর সেই ঋণ কোন কারণে অনাদায়ী হলেও দায় হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারের। সৎ নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাও ঘটনার স্বীকার হয়ে থাকেন অনেক সময়। ফলে সমাজের কাছে ঘৃণিত হয়ে যেতে পারেন, অথবা পরিবারের কাছেও ভুল বুঝাবুঝি হতে হয়। এ ধরনের পার্সেন্টেজ সামান্য হলেও ব্যাংকারদের জীবনে করুন অবস্থার সৃষ্টি করে। তাই বলছি যে, ব্যাংকারদের জীবন নিরস হয়ে উঠে। অনেকের স্বাভাবিক জীবন তিক্ততায় ভরে উঠে কখনও। জালিয়াতচক্র জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা মেরে দিলেও অনেক সময় দায় বর্তায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের উপর। এখন মেশিনে টাকা গুণা হয়। কিন্তু একসময়ে হাতে গুণে গুণে টাকা গ্রহণ ও প্রদান করা হতো। দু’একটি নোট বেশি চলে গেলে পকেট থেকে টাকা দিয়ে পূরণ করতে হতো। বেশি চলে আসলে অধিকাংশ সময়েই তা ফেরৎ প্রদান করা যেতো। এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য বার দেখেছি। যা হোক, সার্বিকভাবে ব্যাংকিং পেশা অত্যন্ত সম্মানের তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এর মধ্যে থেকে সরস সাহিত্য পাঠকের জন্য সৃষ্টি করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। লেখক জনাব জালাল উদ্দিন মাহমুদ সেই কাজটি করেছেন। না, তিনি নিজে লাভবান হবার মানসে তা করেননি। কারণ প্রতিটি খন্ডের ৪/৫টি করে সংস্করণ বের হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অমূল্য সম্পদ অ-মুল্যে বিতরণ করেছেন। ব্যাংকিং সমুদ্রে নেমে তিনি সমুদ্রমন্থন করে যে, গরল গলাধঃকরণ করেছেন, তাতে তিনি নিজে নীলকন্ঠ হয়েছেন। পাঠকদের দান করেছেন অমৃতটুকু।
জনাব জালাল উদ্দিন মাহমুদ ছিলেন ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল নির্বাহী। ডিপুটি জেনারেল ম্যানেজার। ব্যাংকিং জীবনের কঠিন নিয়ম নীতির নিগড়ে থেকে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন। সেটা আবার রসঘন , রঙিন ও হাস্যরসাত্মক- যে কাজটি অনেকাংশে দুরূহ ও কঠিন। এককথায় বলা যায় যে, শুষ্ক কাঠ থেকে সাহিত্যের নির্যাস বের করে এনেছেন। তবে ব্যাংকার দের মধ্যে যে সুসাহিত্যিক নেই তা আমি বলছি না। অনেকে আছেন। তারা ব্যতিক্রমি মানুষ। বহু কষ্ট করে তবেই হয়তো সাহিত্যিক হয়েছেন। অগ্রণী ব্যাংকের এমডি, পরবর্তীতে সোনালী ব্যাংকের এমডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর এবং প্রাইম ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে থেকে সরস সাহিত্য উপহার দিয়ে ছিলেন জনাব লুৎফর রহমান সরকার। ”বুলান্দ জাভির” নামে লিখতেন জনাব ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ, লিখতেন আলামিন বিন হাসিম, লিখতেন আবু হাসান তালুকদার। মনোরঞ্জন দে নামে একজন ডিজিএম ছিলেন। তিনি অবশ্য অর্থনীতি বিষয়ক বহু বই লিখেছেন- যা উচ্চ শিক্ষায় পড়ানো হতো। তবে মজার বিষয় এই যে, তাঁর লেখা বই পড়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা অনেকেই পাস করলেও তিনি নাকি ঐ বিষয়ে একাধিকবার পরীক্ষা দিয়ে তবেই পাস করে ছিলেন। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা সম্পর্কে এমন অনেক জনশ্রুতি আছে। আরও অনেকে লিখতেন। সবার নাম এখানে উল্লেখ করতে পারছি না বলে দুঃখ প্রকাশ করছি। এটা ওনাদের প্রতি অবিচার করার সামিল। (চলবে )