ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : ৬৫পর্ব

Home Page » ফিচার » ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : ৬৫পর্ব
সোমবার ● ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২


 ফারহানা আকতার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে তিনি বাংলাদেশের র্সাবিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবায়ন করেছিলেন অনেক অসাধ্য র্কমসূচির। একটি দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য, বাঙালির হাজার বছরর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, মুক্তযুদ্ধের চেতনা-নির্ভর একটি সময়োপোযোগী আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই যে, যা তিনি র্স্পশহীন রেখেছেন। রেখে গেছেন বাংলাদেশের সব উন্নয়নের শক্ত ভিত। সত্যকিার র্অথে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে র্পযাপ্ত আলোচনা এখনও হয়নি এবং নতুন প্রজন্ম অনকেটা অন্ধকারেই রয়ে গেছে ৷
বঙ্গবন্ধুর শাসনভার গ্রহণের সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ। স্বাধীন বাংলাদশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধু র্সবপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো- ১১জানুয়ারী ‘১৯৭২ তারিখে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রর্বতন। বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন ছিল একটি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার । সেই লক্ষ্যে অস্থায়ী সংবধিান আদেশ জারির পর ১২ জানুয়ারি’১৯৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথমে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করনে। এভাবেই ১৯৭২ সালরে ১২ জানুয়ারি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামল বা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল । ১৯৭৫ সালরে ১৫ আগস্ট স্বপরবিারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলে ঐ শাসনামলের অবসান ঘটে৷ সুতরাং, বলা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল মাত্র ৩ বৎসর ৭ মাস ৩ দিন স্থায়ী ছিল।
বঙ্গবন্ধু সরকাররে শাসনভার গ্রহণের সময় যুদ্ধবধ্বিস্ত বাংলাদেশের চিত্র- বঙ্গবন্ধু যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন সেসময় এই দেশটি নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও নীতির ফলে হয়ে পড়ছিল এক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ভূখণ্ড। এর প্রশাসনিক ও র্অথনৈতিক অবকাঠামো বির্পযস্ত হয়ে পড়েছিল। দেশের শিক্ষ প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা সবকছিুই তখন ছিল বন্ধ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ছিল নামে মাত্র । সারা দেশে ডাক বিভাগ ছিল বন্ধ, তার বিভাগ হয়ে পড়েছিল অচল, অসংখ্য কালর্ভাট-ব্রীজ-সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। মাইন পাতার কারণে নৌবন্দরগুলি ছিল অচল। ব্যাংকগুলি ছিল বন্ধ এবং তহবিল শূন্য।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা রিপোর্টে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নিমরূপ চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে :
Bangladesh inherited a poor, undiversified economy, characterized by an under-developed infra-structure, stagnant agriculture, and a rapidly growing population. She had suffered from years of colonial exploitation and missed opportunities with debilitating effects on initiative and enterprise. Superimposed on all these were the effects of the war of liberation, which caused serious damage to physical infrastructure, dislocation in managerial and organizational apparatus and disruption in established external trading partnership.

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের খাতওয়ারি ক্ষয়-ক্ষতির সংক্ষিপ্ত র্বণনা নিম্নে দেযা হলো :
(১) কৃষি ক্ষেত্রে : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খাদ্য শস্য উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছিল, উপরোন্তু পাকিস্তান বাহিনী পরাজয়রে র্পূব মুর্হূতে সরকারি গুদামে মওজুদ খাদ্যশস্য, শস্যবীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ এবং মাঠের গভীর ও অগভীর নলকূপ ধবংস করছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আয় উর্পাজন ব্যাহত হওয়ায় কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করে আবাদ করার টাকা-পয়সা কৃষকের হাতে ছিল না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী ও রাজাকার-দালালরা কয়েক লক্ষ হালের বলদ ও গাভী চুরী করে খেয়েছে। ফলে হাল চাষের জন্য গবাদি পশুর সংকট দেখা দেয। এসব সমস্যা সমাধানরে জন্য নতুন সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কৃষি ঋণ প্রদান, বীজ সংগ্রহ করা, গভীর ও অগভীর নলকূপ মেরামত বা র্পুনখনন করা, কয়েক লক্ষ গরু আমদানি করা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি পুর্নবাসন কাজ ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান আমলে ভূমি উন্নয়ন ও সেচ র্কাযক্রমের কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ১৯৭১ সালে ৭৪% আবাদি জমি ছিল এক ফসলি এবং মাত্র ২৬% জমি ছিল দো-ফসলি ও তিন ফসলি।বন্যা নিযন্ত্রণ ও জলসেচের ব্যবস্থাও ছিল সামান্য।
(২) খাদ্য সংকট : বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনভার গ্রহণের সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টন। সরকার মাত্র ৪ লাখ টন খাদ্য শস্য মজুদ পান। এমনি সংকটময় পরস্থিতিতে সরকারকে প্রায় নব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী , আটককৃত ৫০-৬০ হাজার রাজাকার ও দালাল এবং প্রায় সোয়া-লক্ষ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জন্য খাদ্য সরবরাহ করার মতো এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় ।
(৩) ধবংসপ্রাপ্ত সরকারী- বেসরকারী ভবন ও শরর্ণাথী পুর্নবাসন : পাকিস্তানী বাহিনী সারা বাংলাদশেে প্রায় ৪৩ লক্ষ বসতবাড়ী, ৩ হাজার অফিস ভবন, ১৮ হাজার প্রাইমারি স্কুল, ৬ হাজার হাই স্কুল ও মাদ্রাসা, ৯ শত কলেজ ভবন ও ১৯ হাজার গ্রাম্য হাট-বাজার পুড়িয়ে দেয় । এগুলো নতুন করে নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণ র্অথের এবং নির্মাণ সামগ্রী ৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি শরর্ণাথী ও দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হওয়া লক্ষ লক্ষ পরবিারকে পুর্নবাসন করার এক কঠিন দায়িত্ব এসে যায় সরকারের সামনে ৷

(৪) বির্পযস্ত শিক্ষ র্কাযক্রম : মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র্কাযত: বন্ধ ছিল। সে সময় পুড়িয়ে দেয়া শিক্ষাভবনগুলো পুননর্মিাণ এবং ধবংসপ্রাপ্ত আসবাবপত্র-সমূহ মেরামত বা নতুন করে নির্মাণ করে ক্লাশ শুরু করা নতুন সরকারের জন্য ছিল এক গুরু দায়িত্ব । তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী পাঠ্য বই রচনা ও প্রকাশের এক গুরু দায়িত্বও সরকারকে পালন করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য শিক্ষক শহীদ হওয়ায় সে পদগুলো পূরণের প্রয়োজন হয়। সমগ্র দেশের শিক্ষকদের ৯ মাসের বেতন বন্ধ ছিল। তা পরিশোধ করা ও সমগ্র দেশের সকল শ্রেনীর শিক্ষক (তথা স্কুল,কলজে, মাদ্রাসা ও বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষক) ও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি যুগোপযুগী শিক্ষা-নীতি ও শিক্ষা-ব্যবস্হা প্রনয়ণ করা ছিল তখনকার সরকারের জন্য এক গুরু দায়িত্ব ।

(৫) বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা : মুক্তিযুদ্ধে র সময় সারা দেশে ২৭৪টি বড় সড়ক সেতু ও ৩০০টি রেল সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সে সময় ৪৫ মাইল রেল লাইনের সর্ম্পূণ অংশ এবং ১৩০ মাইল রেল লাইনের আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়। ১৫০টি বগি ও বেশ কয়কেটি রেল ইঞ্জিন অকজেো হয়। রেল ইঞ্জিন ও বগি মেরামতের কারখানাগুলো সর্ম্পূণ ধবংস করা হয়। সরকারি পরিবহন রত শত শত বাস ও ট্রাক ধবংসপ্রাপ্ত হয়। ধবংসপ্রাপ্ত বেসরকারি বাস ও ট্রাকের সংখ্যা অগণিত। সারা দেশে প্রায় ৩০০০ মালবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হয়। দেশের শতকরা ৮৫টি জলযান ধ্বংস হয়। মাল পরবিহনের সরকারি র্কাগোগুলোও নিমজ্জিত হয়। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে মাইন পাতার কারণে বন্দর দুটি অর্কাযকর হয়েছিল। দেশের বিমান বন্দরসমূহের রানওয়ের ক্ষতি সাধন করা হয়। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য বেসামরিক যাত্রীবাহী কোন বিমান সরকারের হাতে ছিল না।
(৬) বিধ্বংস টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা : মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার সাথে বিভিন্ন জলো শহরসহ বিদেশের টেলি -যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। আত্মসর্মপণের র্পূবে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনগুলোতে পাহারারত পাকিস্তান বাহিনী ট্রাঙ্ক-ব্যবস্থা বিনষ্ট করে দিয়েছিল। তারা টেলিফোন সংস্থার নথিপত্র পুড়িযে দেয । টেলিফোন ব্যবস্থা সচল করার জন্য তাৎক্ষণকিভাবে প্রয়োজন ছিল ঢাকা শহরের জন্য কমপক্ষে ৫০০০ টেলিফোন সেট, ৩১টি ট্রাঙ্ক লাইন নতুন করে স্থাপন, এক্সচেঞ্জের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করা, র্দীঘ টলেফিোন তার আমদানি করা, কমপক্ষে ১০০০ দক্ষ টেলিফোন র্কমী, স্টাফ ও অফিসারদের নিয়োগ দান করা ৷

(৭) বিদ্যুৎ ব্যবস্থা : সারা দেশে বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছি ল। অনকেস্থানে বিদ্যুৎ লাইন বিছ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎ প্যানলেগুলোকে বিনিষ্ট করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় গোডাউনগুলোতে বিদ্যুৎ খুঁটি ও তার কিছুই মজুদ ছিল না। তাই সেগুলো নতুন করে পূর্ন: নির্মানের প্রয়োজন হয়ে পরেছিল৷
(৮) র্অথনৈতিক অবস্থা : আত্মসর্মপণের র্পূবে ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী’ ব্যাংকসমূহে গচ্ছিত কাগজের নোটগুলো পুড়িযে দেয় এবং লুট করে । উপরন্তু ব্যাংকের নথিপত্রও তারা বিনষ্ট করে ৷ পাকিস্তান আমলে বাংলাদশের ব্যাংকগুলোতে র্কমরত র্উধ্বতন র্কমর্কতাদের ৬০% এবং নিম্ন স্তরের র্কমচারীদের ২০% ছিল পশ্চিম-পাকিস্তানী৷তাই মুক্তিযুদ্ধে পর অবাঙালি-পাকিস্তানি র্কমর্কতা-র্কমচারীরা র্কমস্থলে অনুপস্থিত হলে ব্যাংকগুলোতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের প্রায় সকল কল-কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। ফলে এগুলো সচল করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়।

(৯) বির্পযস্ত প্রশাসনিক কাঠামো ও দক্ষ প্রশাসকের অভাব : দেশ পুর্নগঠনের জন্য তাৎক্ষণকিভাবে প্রয়োজন ছিল দক্ষ প্রকৌশলী, কৃষবিদি, ব্যাংকার এবং অভজ্ঞিতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের। ডাক, তার, রেল, কল-কারখানা প্রভৃতি সেক্টরে অভিজ্ঞ র্কমীর প্রয়োজন ছিল।

(১০) সংবধিান ও আইনের শূন্যতা : নতুন সরকারের হাতে কোন সংবধিান ছিল না। ছিল উপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা। স্বল্প সময়ে সংবধিান প্রণয়ন ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের গুরু দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু-সরকারকে পালন করতে হয়।

উপযুক্ত সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করা ছাড়াও নতুন সরকারকে তাৎক্ষণকিভাবে আরও যে সকল চ্যালঞ্জে মোকাবিলা করতে হয় তার মধ্যে উল্লখেযোগ্য ছিল :

(ক) মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নবাসন করা । (চলবে)  তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷

ফারহানা আকতার

লেখক : ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক ৷

বাংলাদেশ সময়: ২০:১৭:২৪ ● ১০৯৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ