সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩৬; স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩৬; স্বপন চক্রবর্তী
শুক্রবার ● ২২ জুলাই ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ: রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম-৮
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অনেকের মন্তব্য এই ভাবে প্রকাশ করতে শুনে থাকি যে, রবীন্দ্রনাথের সাথে যেন বিরাট রকমের প্রতিদ্বন্দিতা, দ্বন্দ বা বিরোধ ছিল । কেহ আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলে থাকে যে, রবীন্দ্র নাথ নাকি নজরুলের সাহিত্য চুরি করে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করে ছিলেন। অতি সম্প্রতি “পুলক ঘটক” নামক একজন সাংবাদিক তার ফেসবুক পেইজে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, তার ষষ্ঠ শ্র্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোন রকম বিশ্রাম না নিয়েই ল্যাপটপের গুগলে কি যেন খোঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি যা বলে, তার ভাষায় তা হলো এমন- আমাদের স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা ক্লাসে পড়িয়েছেন যে, “কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। তিনি বিশ্ব কবি হতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ষড়যন্ত্র করে তাঁকে তা হতে দেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের সংগে তার বোনের বিয়ে দিয়েছিল। সেই মহিলার মাধ্যমে ওষুধ দিয়ে নজরুল ইসলামকে অসুস্থ বানিয়ে দেয় ।” এটা শুধু এই মেয়েটির মনের খটকা নয়, এটি অনেকের। - এই ধরনের অসংখ্য কথা জ্ঞান হবার পর থেকেই প্রায় শোনে আসছি। তবে কোন প্রকার প্রমাণ বা যুক্তি উপস্থাপন তারা করেন না। এটা কোন আবেগের বিষয় নয়, বিষয়টি যুক্তি-প্রমাণের। ইউনিভার্সিটির ক্লাসেও একবার এক ছাত্র এমনটি প্রশ্ন করে ছিলেন শিক্ষক মহোদয়কে। আমরা কিছুটা অবাক বিস্ময়ে উত্তরের অপেক্ষা করতে ছিলাম। উত্তরটি দিতে গিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ আনসারুজ্জামান স্যার ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে গিয়ে ছিলেন। পরে তিনি নিজেকে খুব সংযত করে এই দাবিটি অস্বীকার করে ছাত্রটিকে বহু প্রমাণ দিয়েছিলেন এবং তাকে অর্বাচীন বলে ছিলেন। বলেছিলেন প্রকৃত সত্য জানতে। এ ধরনের অসংখ্য কথা শুনেছি, এখনও শোনা যায়। তবে আমিও ক্ষুদ্র জ্ঞানে নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথের বিরোধের তেমন কোন প্রমাণ আজও পাইনি, বরং উল্টোটি মনে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক অন্তহীন শ্রদ্ধা-ভালোবাসা বিরাজমান ছিল। রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে অপত্য স্নেহ করতেন আর কাজী নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ”গুরুজী” বলে সম্বোধন করতেন। একে অপরের নিকট খুব প্রিয়ভাজন ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার লাভ করে ছিলেন। বিশ্ব সাহিত্য দরবারে বাংলা সাহিত্যকে তিনি পরিচিত করেন। রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন তখন কাজী নজরুলের বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর ( ১৩ বছর ৭ মাস)। এই বয়স পর্যন্ত নজরুলের সাহিত্য কর্ম কতটুকু ছিল? নজরুলের লেখা শুরু হয় তাঁর এগার বছর বয়স হতে। নজরুল তখন লেটো দলের সাথে যুক্ত। রবীন্দ্র নাথের গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থে সর্বমোট ১৫৭ টি গীতিকবিতা সংকলিত হয়েছে। কবিতাগুলি ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা যার অধিকাংশেরই সুরারোপ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। এখানে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, কাজী নজরুল ব্রাহ্ম ধর্মের কোন কবিতা বা গান লিখেননি। আর লিখে থাকলেও আমার জানা নেই। তাঁর লিখার বৈশিষ্ঠ গীতাঞ্জলীর কাব্যগ্রন্থের গীতিকবিতায় অনুপস্থিত। প্রত্যেক্যের কাব্যে এক একটি স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাছাড়াও আরও অনেক ঘটনা তাঁদের সম্পর্কের তথাকথিত বৈরীতার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে। ১৯২৮ সালে এইচএমভি কোম্পানি ইলেকট্রিক রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার উদ্বোধন করেন। কবি নজরুল ইসলাম নিজ কন্ঠে দুটি কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড করেন। কবিতা দুটি ছিল ‘ নারী এবং পরে সেপ্টেম্বর ১৯৪১ “ রবিহারা “। কবি নজরুল ইসলাম তাঁর নিজ কন্ঠে ৬টি গান রেকর্ড করেন। গান গুলো ছিল-
১) দিতে এলে ফুল হে প্রিয় ৮ সেপ্টেম্বর,১৯৩২,
২) পাষাণে ভাঙালে ঘুম, ঐ ।
৩) কেন আসিলে ভাল বাসিলে এপ্রিল ১৯৩৩
৪) দাঁড়ালে দুয়ারে মোর ঐ
৫) ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে: কবির সাথে কন্ঠ দিয়েছিলেন ইলা মিত্র এবং সুনীল ঘোষ।
৬) একি সুরে তুমি গান শোনালে ।
১৯২৯ সালের ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় কাজী নজরুল ইসলাম বেতারে প্রথম আবৃত্তির অনুষ্ঠাণে অংশ গ্রহন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল। কাজী নজরুল ঢাকা বেতার কেন্দ্রের নামকরণ করে ছিলেন “ ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র” । এই কেন্দ্রের উদ্বোধনে কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বাণী পাঠিয়ে ছিলেন। পরের বছর কবি নজরুল ইসলাম স্বয়ং আসেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে । আকাশবাণীর গীতি আলেখ্য অনুষ্ঠানের জন্য গান লিখেন- “ আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়, আমার গানের ফুল গো , আমার গানের মালা গো ,কুড়িয়ে তুমি নিও।”
১৯৩৩ (মতান্তরে ১৯৩৬ ) ৮ জুন ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে “ অল ইন্ডিয়া রেডিও” করা হয়। রবীন্দ্র প্রয়াণ দিনে কাজী নজরুল ইসলামের সেই দিনের স্বরচিত কবিতা “ রবিহারা” কবি কন্ঠে প্রচারিত হয় এবং একই দিনে নজরুল রচিত গান “ ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে “ বেতারে প্রচারিত হয়। তাতে কন্ঠ দিয়ে ছিলেন স্বয়ং নজরুল ইসলাম এবং সুগায়িকা ইলা ঘোষ।– (জানা অজানা নজরুল- সুভাষ সিংহ রায়,)
( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩৮:৩৭ ● ৪২২ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ