সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩৯: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩৯: স্বপন চক্রবর্তী
মঙ্গলবার ● ২৪ জানুয়ারী ২০২৩


ফাইল ছবি-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
( ” সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা “ লেখা অনেক দিন বন্ধ থাকার কারণে অনেকের হয়তো পুর্বের কথাগুলো মনে নাও আসতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে অনেক কথাই লিখেছি। সর্বশেষ লিখেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্ক নিয়ে। তারই আজ চতুর্থ পর্ধ। )

রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্ক-৪

নজরুলের “ বিদ্রোহী” কবিতা নিয়ে কবি ও প্রাবন্ধিক জনাব আলমগীর হোসেন লিখেছেন-
তাঁর আলোড়ন তোলা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা অবিনাশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারী সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কালোত্তীর্ণ কবিতা উঠতি কবি থেকে বয়সে তরুণ হলেও তাঁকে রাতারাতি বিদ্রোহী ও প্রতিষ্ঠিত কবির খ্যাতি এনে দেয়। নজরুলের নাম যশ তখন লোকেমুখেও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আগে কেউ এমন করে কবিতায় খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া উঠার কথা কিংবা ভগবান-বুকে পদ-চিহ্ন এঁকে দেওয়ার মতো দুঃসাহসী কথা বলার স্পর্ধা দেখান নি! পরেও না। রেনেসাঁ প্রভাবিত বিংশ শতাব্দীর প্রথামার্ধে শুধু বাংলা ভাষায় নয় বিশ্বসাহিত্যে কোন কবির বলা সবচেয়ে সাহসী উচ্চারণ। ১৮৮২ সালে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নীৎসে তাঁর এক রচনায় ‘গড ইজ ডেড’ বলে তুমুল আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু প্রকাশভঙ্গী ও ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন উপস্থাপনা ও নান্দনিক চেতনাও। কবিতায় উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোলের জন্যও কবির আহাজারি ও অঙ্গীকার উৎকর্ণ পাঠক ও নিপীড়িতের চৈতন্যলোকে স্পন্দন জাগায়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে এমন পরাক্রমশালী কথা কবিতায় বড়ো দুর্লভ। এর মাশুলও দিতে হয়েছে তাঁকে। রক্ষণশীলরা ক্ষেপেছিলেন নজরুলের বিরুদ্ধে। কেউ বলেছেন কাফের, কেউ বলেছেন শয়তান, কেউ কবির মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন পাগলের প্রলাপ। ইসলাম-দর্শন পত্রিকায় জনৈক মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ নামে একটি তীব্র সমালোচনা লিখেন। সমালোচনা না বলে গালাগালি বলা ভালো। যেখানে কবিকে নরাধম, খোদাদ্রোহী, নাস্তিক, ফেরাউন, নমরুদ বলেও আখ্যা দেন। একই পত্রিকার সম্পাদক নজরুলের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। কিন্তু নজরুল এসব সমালোচনা, ভ্রুকুটি, গালাগালি দলে গেছেন। “আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,/আমি দলে যাই যত বন্ধন,/যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/আমি মানি নাকো কোনো আইন”— যিনি লিখেন তাঁর এসব তৃণতুচ্ছের তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করারই কথা।
তবু থেমে থাকে না স্বজাতি-বেশী শত্রুর সংক্ষুব্ধ সন্তাপ। মোহাম্মদী পত্রিকায় ‘এছলাম ও নজরুল ইসলাম’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে নাজীর আহমদ চৌধুরী নজরুলকে সন্দেহাতীতভাবে ‘এছলামের সর্বপ্রধান শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নজরুলকে যখন সওগাতের আয়োজনে জাতির পক্ষ থেকে এক সংবর্ধনার আয়োজন হয় সে আয়োজন প্রক্রিয়ায়ও মোহাম্মদী পত্রিকার অনুসারীরা বাগড়া দেন। এখানেও সেই মাওলানা নাজীর আহমদকে দেখতে পাওয়া যায়। মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে প্রস্তুতি সভার স্থান দখল করে নজরুল বিরোধী উত্তেজনাকর ভাষণ দেন। সওগাতের তরুণেরা তাদের হটিয়ে প্রস্তুতি সভার কাজ আরম্ভ করেন এবং কবিকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সংবর্ধনা কমিটিতে শরৎচন্দ্র, এ কে ফজলুল হক, দিলীপকুমার রায় এবং ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো প্রখ্যাত লোকদের নাম দেখা যায়। উল্লেখ্য, সংবর্ধনায় সভাপতির ভাষণে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রবীন্দ্রনাথের চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বলতার মধ্যেই নজরুলের নিজের আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠার কথা, নজরুল শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি এবং কবিরা সাধারণত কোমল ভীরু হলেও নজরুল তা নন, কারাগারের শিকল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অন্যদিকে, সুভাষ বসু তাঁর বক্তৃতার একাংশে বলেন, “ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় বহু সুন্দর গান আছে। কিন্তু ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ গানটির কোনো তুলনা মেলে না। তিনি যথার্থই বিদ্রোহী। ‘আমরা যখন যুদ্ধেক্ষেত্রে যাব— তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব।” সত্যি আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ফের নজরুলের গান গাইলাম। যদিও পাকিস্তান পর্বে রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে নজরুলের গান ও কবিতাকে ইসলামীকরণের অপচেষ্টা হয়। সেই ভূতের আছর আজও অনেকের মানসলোক থেকে অপসৃত হয় নি। কবি হিন্দু হন না, কবি মুসলমান হন না, কবি খ্রিস্টান হন না; প্রকৃত কবি হন সকল কালের সকল মানুষের।
যাই হোক, নজরুল রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের মনোভাব জানতেন। মোহাম্মদী ও ইসলাম-দর্শন এরকম কতিপয় পত্রিকাকে ঘিরে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের কতিপয় লেখক নজরুলের বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদগার করেছেন। অথচ নজরুল সে সময় মুসলিম জাগরণের কবিতাও লিখেছেন। তাঁর গজল ছাড়া ঈদ উৎসবের কথা আজ ভাবাই যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ হলে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে আনোয়ারুল কাদিরের বাঙালী-মুসলমানের সামাজিক গলদ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং রক্ষণশীলতার সমালোচনা করেন। শুনে উচ্ছ্বসিত নজরুল বলেছিলেন, “আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে।… এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলবী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।”
( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৩৫:১২ ● ৩৩৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ