রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন:- পর্ব-২৯১ : জালাল উদ্দীন মাহমুদ
Home Page » সাহিত্য » রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন:- পর্ব-২৯১ : জালাল উদ্দীন মাহমুদছুটি নিয়ে ছুটাছুটি -৩
২০০৪ সাল। আমি বগুড়া থেকে সদ্য ঢাকায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পল্লী ঋণ বিভাগে যোগদান করেছি। প্রধান কার্যালয়ের জাষ্ট ক্লারিকাল জব । ম্যানেজারি আর ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং এর ঝঞ্ঝাট নাই ।
কিন্তু খেটে খাওয়ার ভাগ্য আমার। কতদিন আর ঝঞ্ঝাট থেকে দুরে থাকা যায়। ঢেঁকি যেখানেই যায় সেখানেই নাকি ধান ভানতে হয়। তো আমারও ধান ভানা শুরু হলো। ধান ভানার বিষয়টি খুলেই বলি। ম্যানেজার থাকাকালীন আমি অফিসারদের টেবিলে টেবিলে ঘুরে ঘুরে দেখতাম কারো কোনও কাজ পেন্ডিং আছে কিনা। পেন্ডিং থাকলে কাজটি আমিই নিজেই করে দিতাম। এমনকি ক্যাশিয়ারের সামনে বেশি টাকা জমে গেলে -আমার সামনে নিয়ে এসে বান্ডিল গুনে গুনে বুঝে নিয়ে স্বাক্ষর করে দিতাম। তো পল্লী ঋণ বিভাগে এসে দেখলাম কিছু কিছু টেবিলে কিছু কাজ পেন্ডিং পড়ে যায়। দিন দিন কাজ বাড়লেও সে সব জায়গায় নতুন লোকবল দেয়া হয় না। বিশেষ করে নতুন নতুন পলিসি তৈরী, সার্কুলার বানানো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রনালয়ে বিভিন্ন বিবরণী প্রেরন, নতুন উদ্ভাবিত কোন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন ইত্যাদি কাজ। আমি পল্লী ঋণ বিভাগে কারো পরিবর্তে আসি নাই। আমাকে এসপিও হিসাবে পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারে বসানো হলো। আমার টেবিলে তেমন কাজ ছিল না। কারণ এ টেবিল দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা ছিল। তাছাড়া দু‘জন প্রিন্সিপাল অফিসার সেখানে ছিল - যারা ঐ বিভাগের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজলাম। ম্যানেজারি করার সময় যেভাবে কাজ খুঁজতাম। কিছুদিনের মধ্যে পরিসংখ্যানের কাজ ছাড়াও পলিসি ও মনিটরিং বিভাগের অনেক কাজ আমার কাছে এসে গেল। আমি কোন ফাইলের কাজ শেষ করে আবার সংশ্লিষ্ট ইনচার্জকে ঐ ফাইল ফেরৎ দিতে গেলে তারা বলতেন ফাইলটা আপনার কাছেই রাখেন। এভাবে এক সময় ঐ সব বিভাগের অনেক ফাইল আমার হেফাজতে চলে এলো। অন্যদিকে আমার পরিসংখ্যান বিভাগের একজন দক্ষ কর্মকর্তা অন্যস্থানে বদলি হয়ে গেল। তার ফাইলও আমি বুঝে নিলাম। আমার ফাইল কেবিনেট ও টেবিলের দু ধারের ড্রয়ার ফাইলে ফাইলে ভরে গেল। কোন কাজ না হলে বা কোন কাজের জন্য তাগাদা এলে দেখা যেত যেহেতু ঐ ফাইল আমার কাছে তাই কাজটিও আমার। কেন এ কাজটি ও কাজটি হয়নি সে বিষয়ে ডিজিএম সাহেবের বকা-ঝকা শোনা রুটিনে পরিনত হলো। কী আর করা যাবে। সদ্য হেড অফিসে এসেছি। ব্যর্থ তো হতে পারি না। আমি সংসার-দুনিয়াদারী, সব কিছূ শিকেয় তুলে রেখে এক মন এক ধ্যান করে ব্যাংকের কাজের এ চাপ সামলানোর জন্য নিজের মনকে নিজেই রাজী করালাম। এ ছাড়া আর কিই- বা আমার করার ছিল্ নিরীহ-গো বেচারাগোছের লোক আমি , চিৎকার করে প্রতিবাদ করার দিকে না যেয়ে কাজগুলি উপভোগ করার দিকে মনোযোগ দিলাম। মনে মনে ভাবতে থাকলাম ৮ দিনে যদি সপ্তাহ হতো তাহলে আমি আমার সব কাজ শেষ করতে পারতাম। কিন্তু তা তো আর হবার নয়।তাই লোড নিতেই হবে। সাংসারিক জীবনে লোড শেডিং করে অফিসের লোড নেয়া শুরু করলাম।
ওদিকে ঘটলো এক বিড়ম্বনা। এ সময় আমার একমাত্র পুত্র রংপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলো। প্রতি মাসে প্যারেন্টস্ ডে-তে আমার সেখানে যাওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ালো। মাসে অন্তত একদিন মানে শুধু বৃহস্পতিবারের দিনটিতে ছুটি দরকার। তবে বুধবার সহ দুদিন হলে ভালো হয়।
কিন্তু এত কাজ আমার হাতে, আমাকে ছুটি দিবে কে? প্রধান কার্যালয়ের পল্লী ঋণ বিভাগে আমি প্রায় তিন বছর ছিলাম। তিন বছরে তিন জন উপ-মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। আমাকে ছুটি দেবার বেলায় তিন জন যে তিন রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতেন তা ছিল রীতিমতো রোমাঞ্চকর। একে একে সেসব কথাই বলব এখন।
প্রথম ডিজিএম ছিলেন - না নাম থাক। তিনি একজন কৃষিবিদ। খুব ভালো মানুষ। ছুটি নিতে গেলাম স্যারের কাছে। সামনে প্যারেন্টস ডে। রংপুর ক্যাডেট কলেজে যেতে হবে। যাবার পথে আবার বগুড়ায় বাবা-মাকে দেখতে যেতে হবে। স্যারের রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বিনীতভাবে দু‘দিন ছুটির কথা বললাম। ভদ্র মেজাজের স্যার হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রথমে চোখগুলো একটা নিরীহ প্রাণীর মত বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। দাঁত কড়মড় করলেন। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। শার্টের হাতা গুটানো শুরু করলেন। মনে হলো মারধর করার পূর্ব প্রস্তুতি স্যার গ্রহন করছেন। আমি যারপর নাই বিমর্ষ হলাম। বোধহয় কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলাম। স্যারের চেম্বার থেকে পালিয়ে যাব কিনা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। স্যার যেন হুংকার ছাড়লেন। বললেন,“জালাল, আমার মুখের উপর এতবড় কথা বলতে পারলেন”।
-এত বড় কথা? কি এত বড় কথা বললাম স্যার ?
-আপনার হাতে এত কাজ,এতো ফাইল আর আপনি ছুটি চান কোন বিচারে? আপনার হাতে রানিং ফাইল কতগুলো আছে?
-২৪/২৫ টা হবে স্যার।
-তাহলে আপনি কোন হিসাবে ছুটি চান। সামনের সপ্তাহে পল্লী ঋণ নিয়ে এমডি স্যারের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্যারের মিটিং আছে। তার ফাইল পত্র তৈরী করবে কে?
-স্যার আমি ছুটি থেকে এসে সব করে দিব।
-সারা দেশের সব শাখা থেকে তথ্য আনতে হবে। তারপর সেগুলো যাচাই বাছাই করতে হবে। সাজাতে হবে।কম্পিউটারে পোস্টিং দিতে হবে। অনেক সময় লাগবে। এ ছাড়াও আপনার হাতে আরো অনেক জরুরী কাজ আছে। ছুটি হবেনা, যান-
আমি বিরস বদনে স্যারের চেম্বার থেকে বের হয়ে যিনি ছুটি ডিল করেন সেই স্টাফ অফিসারের কাছে গিয়ে তার পাশে বসলাম। উনি অভ্যাস মাফিক বললেন, দেশী ভাই (উনি যদিও অন্য জেলার) আপনার মোবাইল থেকে একটা কল দেয়া যাবে? বললাম যাবে। উনি কল করলেন। এইস্টাফ অফিসারের কাছে বসলেই উনি সর্বদাই একই কথা বলে মানে আমাকে দেশী ভাই সম্বোধন কোরে আমার মোবাইল থেকে কল করতে চায়। আজও করলেন।
সে সময় কলচার্জ অনেক বেশী ছিল । যতদুর মনে পড়ছে গ্রামীণ ফোনের সে সময় প্রতি মিনিট কল চার্জ ভ্যাটসহ ৬.৭৫ টাকা ছিল। আর ছিল ১ মিনিটের পালস। সে সময়ের নিরিখে এ কলরেট ছিল অনেক বেশী আর সে সময় আমাদের বেতনও ছিল কম। তাই সে যখন কল করতো তখন আমি একধ্যানে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার গ্রামের এলাকায় ফোনের নেটওয়ার্ক তেমন একটা শক্তিশালী ছিল না।নেটওয়ার্ক খুঁজতে গাছে চড়তে হতো। দেশে সে সময় মিসড কল সংস্কৃতি শুরু হয়ে গেছে। সেও মিসড কল সাঙ্কেতিকভাবে ব্যবহার করত । প্রথমে একটা মিস কল দিত । ও প্রান্তের লোক তখন গাছে উঠে মিস কল দিন । তখন ইনি কথা বলত। সে সময় গ্রামীণফোন তাদের প্রি-পেইড ‘ইজি’ প্যাকেজের কার্ড চালু করেছে। আমি ৫০/১০০ টাকার কার্ড কিনতাম। কোনও কোনও দিন তা শেষ হবার পর তার কথা থামত। অফিসে ল্যান্ড ফোন ছিল কিন্তু সে সময় ল্যান্ড ফোন থেকে মোবাইল ফোনে কথা বলা যেত না। অফিসের অনেকেই সে কালের বড় সাইজের হ্যান্ডসেটগুলি পকেটে না রেখে একটা ভাব নিয়ে হাতে নিয়ে চলাফেরা করত। কেউ ফোন করতে চাইলে বলত ব্যালান্স শেষ । আমি আবার এটা করতে পারতাম না ।
দীর্ঘ সময় ধরেই এই কল চার্জ চালু ছিল। বাংলালিংক আসার পর ২০০৫ সাল থেকে ফোন কলের ট্যারিফ কিছুটা কমতে শুরু করে। চালু হয় ৩০ সেকেন্ডের পালস । ততদিনে অন্য এক কারনে এ স্টাফ অফিসারের ফোনের চাহিদারও ইতি ঘটে।
আমাদের দেশে মোবাইল ফোন আগমনের প্রথমদিকে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। কল চার্জ অনেক বেশি ছিল, পালস ছিল এক মিনিটের, নেটওয়ার্ক ভাল ছিল না। তবুও আমরা সেই সময় এই প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলাম। সময় এর প্রেক্ষাপটে সেটাই হয়ত ঠিক ছিল। আজ সে স্টাফ অফিসারের কথা বাদ দিয়ে কেনও জানি না মোবাইল ফোন আগমনের প্রথমদিকের কথাগুলিই বেশি করে মনে পড়ছে।
যা হোক ,তার কথা শেষ হলে আমি আমার ছুটির প্রসঙ্গটা তুললাম। উনি বললেন- আপনি ডিজিএম স্যারকে আপনার ছুটির ব্যাপারটি বলেছেন কিনা? বললাম-বলেছি। উনি বললেন-তা হলেই হলো। আপনি দরখাস্ত রেখে যান। আমি দেখব। তবে একদিনের বেশী ছুটি নিবেন না। এরপর যতদিন ঐ ডিজিএম স্যার ছিলেন ততদিন প্রত্যেক মাসেই রংপুরে যাবার জন্য ঐ একই পদ্ধতিতেই আমি ছুটি নিতে থাকলাম। শুধু একটা পাথর্ক্য হলো - উনি জামার হাতা গুটিয়ে বলতেন, গত মাসেও এভাবে ছুটি নিয়ে সটকে পড়েছেন। এরূপ আর কোনও দিন করলে কিন্তু খবর আছে। আমি রুম থেকে বেরিয়ে এসে স্টাফ অফিসারকে দরখাস্ত দিয়ে চলে যেতাম। তবে মজার ব্যাপার হলো , স্যার কোনও দিনও ছুটি শেষে ফিরে আসলে এ বিষয়ে আর প্রশ্ন করতেন না। চোটপাট যা করার তা ছুটি নেয়ার আগেই করতেন।
( চলবে )
** লেখক অগ্রণী ব্যাংকের প্রাক্তন ডিজিএম। তাঁর লেখা একাধিক রসালো বই প্রকাশিত হয়েছে। কর্ম জীবনের চলার পথে যে সব ঘটনা দেখেছেন, তা তিনি রসিয়ে রসিয়ে লিখেতে সক্ষম, তাই তিনি পাঠক নন্দিত একজন কবি ও লেখক।
বাংলাদেশ সময়: ৭:৫৮:৪৮ ● ২৭৩ বার পঠিত
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)-
আজ নামতে পারে বহু প্রতীক্ষার সেই বৃষ্টি !
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
মিল্টনের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে : ডিবি প্রধান
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
অবশেষে গ্রেপ্তার হলো সেই প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
চীনের গুয়াংডং প্রদেশে রাতে মহাসড়ক ধসে নিহত ২৪
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র জমা নিতে প্রার্থীর বাড়িতে লোক পাঠালেন
বুধবার ● ১ মে ২০২৪ -
হাজারো শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস শ্রম আদালতে
বুধবার ● ১ মে ২০২৪ -
নলকূপে পানি মিলছে না খুলনা-যশোরের বেশির ভাগ
মঙ্গলবার ● ৩০ এপ্রিল ২০২৪ -
মার্কিন প্রতিনিধি পোশাকশিল্প নিয়ে তদন্তে ঢাকায়
মঙ্গলবার ● ৩০ এপ্রিল ২০২৪ -
কলেরা রোগী গরমের সঙ্গে বেড়েছে
মঙ্গলবার ● ৩০ এপ্রিল ২০২৪ -
আজ প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকক থেকে দেশে ফিরছেন
সোমবার ● ২৯ এপ্রিল ২০২৪
-
মিল্টনের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে : ডিবি প্রধান
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
আজ নামতে পারে বহু প্রতীক্ষার সেই বৃষ্টি !
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
চীনের গুয়াংডং প্রদেশে রাতে মহাসড়ক ধসে নিহত ২৪
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪ -
অবশেষে গ্রেপ্তার হলো সেই প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার
বৃহস্পতিবার ● ২ মে ২০২৪
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]