আমি লজ্জিত দুঃখিত ব্যর্থ - অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম

Home Page » সাহিত্য » আমি লজ্জিত দুঃখিত ব্যর্থ - অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
রবিবার ● ৯ জুলাই ২০২৩


অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
আমি নিজেই লজ্জিত,দুঃখিত ও ব্যর্থ। মানব কল্যাণে
আমার বহু কিছু করা উচিৎ ছিলো, পারিনি। এখন জীবনের লাল বাত্তি জ্বলে ওঠছে প্রায়। আর কিছু কি করতে পারবো? তারপরও হাত পা নাড়া চাড়া করি, মঙ্গলের পেছনে দৌড়াই। অসঙ্গলকে রাখি দুরে সরিয়ে।সাদা মনের মানুষ খুঁজি। শ্বেত কবুতরের পায়ে বেঁধে দেই সততার চিঠি।

নিজেকে প্রশ্ন করি — আমি কি জনমের ঋন শোধ করতে পেরেছি। যারা ফুটপাতে ঘুমায় , রোগে শোকে কাতরায়,না খেয়ে কাঁদে তাদের জন্যে কি করতে পেরেছি। যায় না শিশু স্কুলে, নেশায় থাকে ডুবে, শিশু গ্যাং দলে মিশে করে মাস্তানী চুরি চামারি, মোবাইলে ঘুরে অপকর্মের জগতে, তাদের জন্য মঙ্গল কামনায় কতটুকু সময় ব্যয় করেছি। ফুল ফুটাবার স্বপ্ন কি দেখাতে পেরেছি। মানবীয় আচরণগুলো গেঁথে দিতে পেরেছি শিশুদের মস্তিষ্কে? এই ব্যর্থতা কার? আমার ও আমাদের।

ধর্ষিতা নারী পিতৃ পরিচয় হীন সন্তান বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে। ঘরে, বাইরে, যাত্রা পথে, কর্মস্তলে নারীর নিরাপত্তার বিধি থাকলেও প্রকৃত অর্থে তা নেই। ধর্ষণ শেষে কলংক মুক্ত হওয়ার জন্য, ধর্ষিতাকে ঘুম করে,পুড়িয়ে মারে,আত্ম হত্যা বলে বিভ্রান্ত করে।পরোকীয়া একটি মারাত্বক ঘৃন্য ব্যাধি। তা জানার পরও সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে। এ সমস্ত অপকর্মের লজ্জা ঢাকবো কি দিয়ে।

নারী জাগরনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে অনুসরন করে দশ জন শিক্ষার্থী নিযে রহিম ছাত্তার আইডিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। আলোর ফুল ফুটিয়েছি মাটির ক্যানভাসে। নারী জাগরণের চেতনা গ্রাম্য নারী সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি। এক দিন নারীর দুঃখ ঘুছবে,সমতালে পুরুষের সাথে ফেলবে পা।

হাতে তুলে কলম নারীর দুর্ভ্যাগের কথা,অধিকার প্রতিষ্টার কর্ম কৌশল-,নারী পুরুষে সমাধিকারের দাবি — কাব্যকথায়,গানে, গল্পে,প্রবন্ধে,ছড়ায়,নাটকে যুক্তি তর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হলেও পথ ছাড়িনি। অনবরত শ্রম ঘাম ব্যয় করে যাচ্ছি, অচিরেই নারীর ভাগ্য রেখায় সোনালী পালক যুক্ত হবে এই প্রত্যাশায়।

মেয়েটি পড়তে বসলেও ছেলেটি লাইন চুত্য হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে মিশে, এসব খোঁজ খবর কি বাবা রাখছে? না, বাবা তো শুধু টাকা চাই তো, খ্যাতি পদবি ইত্যাদির আলোর নেশার পেছনে দৌড়াচ্ছে। মা বেচারি কি করবে, না পারে সন্তান বা বাবার সামনে প্রতিবাদের দেয়াল তুলে দাঁড়াতে। এ ভাবেই সামাজিক অবক্ষয় আমাদের জীবনে বাসা বাঁধছে। আমরা তা দেখেও না দেখার ভান করি।

পায়ের নীচে মাটি নেই,লবণ লংকার জীবন, সামনে গাঢ় অন্ধকার।তারপরও একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে জনসংখ্যার গণ বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। বলছে আল্লাহ মুখ দিলে আধার দিবে।তাদের মূর্খতা দেখে কি বলবো।
বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধান নারী পুরুষকে সমাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। পৈতৃক স্থাবর অস্থাবর সম্পতিতে নারীরা পায় কি সমতার মর্যাদা। এমন কি জঠর নিসৃত সন্তানেও নেই নারীর মালিকানার অধিকার।স্বামীর সম্পত্তিতে ২% অংশিদারিত্ব পায়, যদি স্বামী তার স্ত্রীর পুর্বে মারা যায়। অন্যথায় এক কানাকড়িরও ভাগিদার নয়।

বাবার বাড়ী,স্বামী ঘর, সন্তানের রাজপ্রাসাদ কোনটাই নারীর স্থায়ী ঠিকানা না। তিন জন প্রভু সন্তান, স্বামী,বাবা, তাদের রুচি, পছন্দ, মন, মর্জির উপর নির্ভর করে নারীকে বাঁচতে হয়। অথচ নারীর জঠরই দিয়েছে এই সমস্ত প্রভুদের নিরাপত্তা, পৃথিবীতে আসার কড়িডোর। হায় অভাগা নারী।

মেয়ে সন্তানটিকে রাখতে হয় চোখে চোখে।কেন না যে কোন সময় শিয়াল,কাক,, শকুন চিনতাই করে নিতে পারে যৌবনের ফুল। পায়ে পায়ে হাঁটে ভয়,দুশ্চিন্তা।এই সেই করা যাবে না, নারীরে লুকিয়ে থাকতে হবে মুরগীর বাচ্চার মত পাখার নীচে।কিন্তু কেন? এই লজ্জাজনক অবস্থা কেন রোধ করতে পারি না।

ঈদে পর্বে,নব বর্ষে ছেলে সন্তানকে দেই দামী জামা কাপড়, খেতে বসলে মাছের ভালো টুকরা টা ছেলের প্লেইটে তুলে দেই।পরিবার থেকে শুরু করি মেয়ে শিশুকে অবমূল্যায়ন।
অর্থ,বিত্তে,পেশী শক্তিতে যারা সবল, তারা নবাবী হালে চলে। দূর্বলকে করে শোষণ, নির্যাতন, প্রয়োজনে স্বার্থের টানে দূৃর্বলের মাথায় ভাঙ্গে কাঁঠাল। কেড়ে নেয় মুখের গ্রাস।মানবীয় মূল্যবোধ পালিয়ে যায় দরজা জানালা ভেঙ্গে। এটাও সামাজিক অবক্ষয় ও মানবতার পরাজয়।

কেউ কেউ প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে,অন্যের শুনাম, গৌরব,সফলতাকে মেনে নিতে পারে না। বরং সম্ভব হলে কুৎসা রটনা করে, সোনালি সাফল্যে কাদা লেপ্টে দেয়।গলা টিপে হত্য করে নিজের দেশের, দশের, স্বজনের অর্জিত গর্বময় অর্জনকে। মানুষ দানবে রুপান্তিরত হয়।
পায়ের পেছনে পা হাটবেই। পুবের সূর্য পশ্চিমে হারাবে।ঘড়ির কাঁটা সামনে এগিয়ে যাবে।শোষে নিবে আমাদের নিঃশ্বাস। এই তো প্রকৃতির খেলা। আমরা প্রকৃতির নাচের পুতুল। কার টানে কার ইশারায় খেলছি পুতুল খেলা, জানি না।

মাটিতে হামাগুরি দিয়ে ধূলাবালি গায়ে মেখে বড় হয়েছি। সোনালি আঁশ, ধান, জার্নিবাই বোড, জীবনের লক্ষ্য কি — ইত্যাদি রচনা শিখে পরিক্ষার খাতায় লিখে বড় হয়েছি।ক্লাশে পড়া না পারনে কানে ধরে বেঞ্চের উপরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন স্যার। ডাস্টার দিয়ে পিঠাতেন, মাথা বেঞ্চের নীচে দিয়ে বসিয়ে শাস্তি দিতেন। আজকাল শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন কি মানসিক নির্যাতনও করা যাবে না। এ কারনেই শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে আসতে চায় না। স্যারদের ভয়ও পায় না।সে জানে যে কোন অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। শিক্ষার্থী তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে খুন করেছে, এমন উদাহারণও আছে।

২০২৩ সাল থেকে আসছে পরীক্ষাবিহিন শিক্ষা পদ্ধতি। বছর ব্যপি ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় মেধা যাচাই করা হবে। শিক্ষার্থীদের প্রেসারে না রাখলে পড়া শোনার ধারে কাছেযেতে চায় না। পরীক্ষা দিতে না হলে,তারা হাতে বই তুলবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

শিশুরা প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহন করার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে স্কুলে যাবে। সেখানে সরকারি বিধি মোতাবেক শিক্ষা গ্রহন করবে। নেচে,গেয়ে,খেলাধুলা করে আনন্দঘন পরিবেশে নিজের অজান্তেই শিক্ষা নামক বিরাট জগতে ঢোকে যাবে। কিন্ত অতি কচি বয়সে, ফুলের মত শিশুর কান্না থামাতে, ঘুম পাড়াতে,খেলার ছলে খাওয়াতে হাতে তুলে দেই স্মার্ট মোবাইল ফোন। শিশুটি নিজেও জানে না কি গেইম দেখছে। সে ক্রমান্নয়ে মোবাইলে নেশা গ্রস্থ হয়ে পড়ে।তাতে শিশুটির শারিরীক, মানসিক, দৈহিক ক্ষতি হয়, সে খেয়াল কি আমাদের আছে? আমরাই তো শিশু বয়সে সন্তানকে অন্ধকার জগতে ঠেলে দিচ্ছি। এর দায় আমাকে আপনাকে বহন করতে হবে।

শিল্প বিপ্লবের পর তথ্য প্রযুক্তির যুগে পৃথিবী গলোবাল ভিলেজে পরিনত হয়েছে। সামনে এগিয়ে আসছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব।এ যুগেও আমরা পানি পড়ায় বিশ্বাস করি। মানত করি দরগায়।হুজুরের পায়ে লুটিয়ে পরি কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়।
তখন নিজে লজ্জিত হই। দুঃখের সীমা রেখা টেনে বুক বিজাই। পৃথিবীর সকল অর্জনসহ নিজেকে মনে করি ব্যর্থ।

লেখকঃ উপদেষ্টা সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।

বাংলাদেশ সময়: ১:৩৪:১৪ ● ৬৬৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ