সহিংসতায় অর্থনীতিতে বাড়ছে

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » সহিংসতায় অর্থনীতিতে বাড়ছে
মঙ্গলবার ● ১ আগস্ট ২০২৩


অর্থনীতিতে বাড়ছে অনিশ্চয়তা

 বঙ্গ-নিউজঃ    উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা, উন্নয়ন কাজে শ্লথগতি, বিনিয়োগে মন্দা- বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ নানা চাপে টালমাটাল দেশের অর্থনীতি। সংকট সামাল দিতে নানামুখী উদ্যোগ থাকলেও শিগগির স্বস্তির ইঙ্গিত নেই। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগসহ নানা কর্মসূচিতে অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনীতির এই অবস্থায় হরতাল কিংবা অবরোধের মতো কর্মসূচি এলে পণ্য চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। আর তাতেই বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি।   বাড়লে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবেন দেশি এবং বিদেশি উদ্যোক্তারা। উন্নয়ন কাজেও নেমে আসবে স্থবিরতা। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও পড়বে নেতিবাচক প্রভাব।

গত কয়েক দিনের পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে তৈরি অনিশ্চয়তায় অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণ তো দূরের কথা, এমন অবস্থা চলমান থাকলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় তৈরি হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে সহিংস কর্মকাণ্ড চলমান থাকলে অর্থনীতিতে কঠিন অভিঘাত তৈরি করবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও মনে করেন, মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগে সরাসরি প্রভাব পড়বে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, যেকোনো অরাজকতা অর্থনীতির জন্য বিপদ ডেকে আনে।

থমকে যাবে উৎপাদন
নির্বাচন নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচনী বছরে থমকে যায় বিনিয়োগ। বিশ্লেষকরা বলছেন, নানামুখী চাপ অর্থনীতিতে স্পষ্ট; প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তবে, এই সময়ে টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জিং।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় তা সংশোধন করে নামিয়েছিল ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়নি। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থাগুলোও কমিয়ে নির্ধারণ করেছে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন। এমন অবস্থায় নির্বাচনকেন্দ্রিক হানাহানি তৈরি হলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমে যাবে মোট দেশজ উৎপাদন। এ ক্ষেত্রে বাড়তে পারে বেকারত্ব।

মূল্যস্ফীতি
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ঘাটতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সংকটে দেশের স্বল্প আয়ের বড় সংখ্যক মানুষ। ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে অর্থনৈতিক এই সূচকের হার। অর্থাৎ প্রকৃত দামের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনছে মানুষ। আয় না বাড়লেও ব্যয়ের এমন চাপ স্বল্প ও মধ্যবিত্ত বড় সংখ্যক মানুষকে চাপে ফেলেছে।

এমন অবস্থায় রাজনীতিতে সহিংসতা বাড়লে উসকে যাবে পণ্যমূল্য। পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে বেড়ে যাবে দাম। এতে ক্রয়ক্ষমতা হারাবে সাধারণ মানুষ। বলা হচ্ছে, করোনা এবং যুদ্ধের কারণে এমনিতেই পণ্য সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্য যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে না পৌঁছানো যায়, তাহলে মানুষের কষ্ট বাড়বে। কৃষক বঞ্চিত হবে নায্য দাম থেকে, ক্রেতাকেও বেশি দামে কিনতে হবে পণ্য।

বিনিয়োগে তৈরি হবে অনিশ্চয়তা
দুর্নীতি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাবসহ নানা কারণে এমনিতেই থমকে আছে বিদেশি বিনিয়োগ। দেশি বিনিয়োগেও অবকাঠামোগত সমস্যা বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট তীব্র হয়েছে।

এমন অবস্থায় রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে হাতগুটিয়ে নেবে সবাই। কারণ অনিশ্চয়তার মধ্যেও অর্থের সুরক্ষা দেয়া কঠিন। একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, অর্থ লগ্নি করে তা যদি সঠিক ব্যবস্থাপনা না করা যায়, তাহলে নানা ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হবে। বলা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নানা কারণে আটকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। তারপরও রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বিনিয়োগ করা যাবে না।

রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব
নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অনিশ্চয়তায় রপ্তানিমুখী খাত। এই খাতের ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন। তাদের অনেকের ধারণা, রাজনৈতিক সংঘাত হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে। রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন তারা। সতর্কতা হিসেবে রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছে অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানার রপ্তানি আদেশ কমছে বেশি হারে। সুযোগ বুঝে কোনো কোনো ক্রেতা পোশাকের দর কম দিতে চাইছেন। এ পরিস্থিতিতে পড়া কারখানাগুলো শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তীব্র হবে সংকট
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, মানুষ শান্তিতে চলাচল করতে পারবে না। ফলে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাওয়া কমে যাবে। এখানে ব্যবসাও কম হবে। দেশের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে যাবে না। সেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পর্যটনে। উৎপাদন কমে যাবে। কারণ বিক্রিও কম হবে। বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশের দিকে ঝুঁকবে।

তিনি জানান, সংকট তীব্র হলে রপ্তানি আদেশ কমে যাবে। কারণ বাইরের বায়াররা রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল না হলে এখানে অর্ডার করতে চাইবে না। ইতোমধ্যে কিছু অর্ডার অন্য দেশে চলে গেছে। আগামীতে এটা বাড়বে। রপ্তানি না হলে দেশের আয় কমে আমদানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর রপ্তানি আদেশ কমলে বাণিজ্যিকভাবে যদি কারখানাগুলো টিকতে না পারে, তাহলে কাজ হারাবে সাধারণ শ্রমিক। বেকারত্ব বাড়বে। কর্মসংস্থানের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।

২০২০ সালে কোভিড-১৯-এর কারণে অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় নেমেছিল সেটা ২০২১ সালে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। কিন্তু ২০২২ সালে ডলার বাজারের অস্থিরতার কারণে অর্থনীতিতে আবার বিরূপ প্রভাব পড়ে। যেটা এখনো চলমান। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সরকার চেষ্টা করলেও মূল্যস্ফীতি আরও চড়া হবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, নির্বাচন পার করতে হলে টাকা দরকার। সে ক্ষেত্রে টাকা ছাপানোর বিকল্প নেই। আর নতুন করে টাকা ছাপানোর ফলে মূল্যস্ফীতির পারদ আরও চড়া হবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে পরিবর্তন আনা জরুরি। তিনি বলেন, অর্থনীতি এমনিতেই চাপে রয়েছে। এর মধ্যে সহিংস অবস্থা অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে সহিংসতা এর আগেও হয়েছে। তখন অর্থনীতি বিপদে পড়েছে। এবারও সেই শঙ্কা তীব্র হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দিন থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে সারা দেশে সহিংসতায় ১২৩ জন মারা যান। আহত হন অনেকে। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে সহিংসতায় ১৭ জন মারা যান। আগামী ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দেশে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪:১১:১৯ ● ২১১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ