শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল

Home Page » প্রথমপাতা » শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল
বুধবার ● ৪ জুন ২০২৫


শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল

বঙ্গ নিউজ ডেস্ক:মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ-এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাতে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগ থেকে প্রকাশ করা অধ্যাদেশে এসব নেতার পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিন রাত ১১টার দিকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারই নন, আরও চার শ্রেণির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর প্রথম শ্রেণিতে রয়েছেন যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন; দ্বিতীয় শ্রেণিতে যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর) অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী বা দূতসহ অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; তৃতীয় শ্রেণিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং চতুর্থ শ্রেণিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০২২’-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রবাসী সরকারের এমএনএ, এমপিএ এবং উল্লিখিত চার শ্রেণির সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। নতুন অধ্যাদেশে তাদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করা হয়েছে। এর ফলে তাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল হয়ে গেল।

জামুকা আইন সংশোধনের চূড়ান্ত খসড়াসহ এ-সংক্রান্ত কার্যপত্র গত ১০ মার্চ স্বাক্ষর করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। এ নিয়ে ২১ মার্চ ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার’ শিরোনামে সমকালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা দেখা দেয়। এর পর খসড়াটি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কয়েক দফা আলোচনা হয়।

জানা গেছে, প্রথম দফায় ৬ মে চার শতাধিক রাজনীতিবিদ, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে বিজয়ীদের স্বীকৃতি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হয়। এ পর্যায়ে ১৫ মে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনার শর্তে খসড়াটি অনুমোদন করা হয়। এর পর আইন মন্ত্রণালয় সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার বিষয়টি অনুমোদন দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে গতকাল অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী মঙ্গলবার রাতে বলেন, খসড়া নিয়ে কয়েক দফা উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ শর্তসাপেক্ষে এটি অনুমোদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাইয়ের পর খসড়াটি চূড়ান্ত করে অধ্যাদেশ জারির জন্য পাঠানো হয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অধ্যাদেশটি জারি হয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা শিগগিরই হালনাগাদ করা হবে।

সংজ্ঞায় পরিবর্তন
অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল প্রণীত খসড়া থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।

অধ্যাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থ যাহারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়াছেন এবং যে সকল ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করিয়া ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাহাদের নাম অর্ন্তভুক্ত করিয়াছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছেন, এই রূপ সকল বেসামরিক নাগরিক উক্ত সময়ে যাহাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্য এবং বাংলাদেশের নিম্নবর্ণিত নাগরিকগণও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হইবেন, যথা (ক) হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাহাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত সকল নারী (বীরাঙ্গনা) এবং (খ) মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারী।’

মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তিত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “‌মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতিবিদ

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২’ জারি করেন। ওই বছরের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয়। এই আদেশবলে ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯-এর (জাতীয় পরিষদে ১৬৯, প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০) মধ্যে ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় গণপরিষদ। ৪০৩ জনের মধ্যে ৪০০ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের, একজন ছিলেন ন্যাপের আর দু’জন নির্দলীয়। স্বাধীনতার পর প্রণীত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৬১ জনকে ‘লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা’ শ্রেণিতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ গণপরিষদের সদস্যও আছেন।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বর্তমানে ৩৬টি শ্রেণি রয়েছে। অধ্যাদেশ জারি হওয়ার ফলে ‘লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা’ ক্যাটেগরি থেকে গণপরিষদ সদস্য, বিসিএস ধারণাগত খেতাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিশ্বজনমত গঠনকারী প্রবাসী সংগঠক, মুজিবনগর, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় বাতিল হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ৮:৪৩:০২ ● ৪৭ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ