
বঙ্গ নিউজ:বাংলাদেশে সম্মানী কম এবং তা পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ায় পাবলিক পরীক্ষার খাতা দেখতে চান না শিক্ষক-পরীক্ষকরা। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়েও তাদের আগ্রহ কম। এবার শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে অনেকটা জোর করে খাতা দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের।
তবে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিংয়ে যুক্ত থাকলে আয় বেশি হওয়ার কারণেও শিক্ষকরা দিন দিন খাতা দেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। অনেক শিক্ষক নিজেরা খাতা দেখেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্বজনকে দিয়ে খাতা দেখানোয় অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়। এর প্রভাব পড়ে ফলে। দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে এ বছর এ নিয়ে শিক্ষকদের চূড়ান্ত সতর্ক করা হয়েছে। শিক্ষকরা সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না করায় পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর পুনর্মূল্যায়নে বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী আগের তুলনায় বেশি নম্বর পাওয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তদন্তেও পরীক্ষকদের ভুলের বিষয়টি উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকের অনেকেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার খাতা দেখায় অনীহা প্রকাশ করেন। এতে এবার ফল মূল্যায়নে জটিলতাও তৈরি হয়। গত মে মাসের মাঝামাঝি পরীক্ষা শেষ হলেও পরীক্ষকরা বোর্ড থেকে মূল্যায়নের জন্য খাতা নিতে যাচ্ছিলেন না। এ পরিস্থিতিতে গত ১৩ মে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকদের খাতা নিয়ে যাওয়ার কঠোর নির্দেশনা দেয়। খাতা না দেখলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করা হয়।
ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, আবেদন করে প্রধান পরীক্ষক ও পরীক্ষক হলেও শিক্ষকদের অনেকেই খাতা মূল্যায়নে অনীহা প্রকাশ করছেন। তাদের নির্ধারিত বিষয়ের খাতা বোর্ডে পড়ে থাকে, তারা তা নিতে চান না।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের রেওয়াজ রয়েছে। গত ৫ মে পরীক্ষকদের সতর্ক করে চিঠি দেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো। পরীক্ষার খাতা অন্যকে দিয়ে দেখালে পরীক্ষকের জেল-জরিমানা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহ্বায়ক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, পরীক্ষা পরিচালনা আইন অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষার খাতা অন্যকে দিয়ে মূল্যায়ন করানো বা বৃত্ত পূরণ করানো শাস্তিমূলক অপরাধ।
এর আগে শিক্ষকদের খাতা দেখায় অনীহার বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। রিট আবেদনের পর যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার খাতা দেখতে বোর্ড কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং খাতা দেখার জন্য সঠিক ও প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হবে না– তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, ফল পুনর্নিরীক্ষণের অর্থ নতুন করে খাতা দেখা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। মূলত উত্তরপত্রের নম্বর যোগ ও বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কিনা, তা দেখেই পুনর্নিরীক্ষণ শেষ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নম্বর যোগ-বিয়োগের ভুলেই প্রতিবছর একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়। এ ক্ষেত্রে পুনরায় খাতা দেখলে আবেদনকারীর বেশির ভাগেরই ফল পরিবর্তন হতো। পরীক্ষকদেরও আরও ভুল ধরা পড়ত।
পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন বেড়ে যাওয়ায় ও পরীক্ষকদের ভুল নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এ বিষয়ে গবেষণার জন্য বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটকে (বেডু) দায়িত্ব দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের গবেষণায়ও খাতা মূল্যায়নে ত্রুটিপূর্ণ হচ্ছে বলে প্রমাণ মেলে। তারা বলছে, ভুল উত্তরের জন্য নম্বর দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেক সময় সঠিক উত্তরের ক্ষেত্রেও নম্বর কম দেওয়া হচ্ছে। প্রধান পরীক্ষকদের খাতা ফের দেখে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সে কাজ ঠিকভাবে করেন না। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের নামকরা শিক্ষকরা খাতা দেখেন না বলেও প্রমাণ পেয়েছে বেডু।
জানা গেছে, অযোগ্য পরীক্ষক ঠেকাতে এর আগে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষকদের ডিজিটাল ডেটাবেজ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের গাইডলাইন ছাড়া তৈরি এই ডেটাবেজেও ঢুকে পড়ছেন অযোগ্য শিক্ষকরা। প্রতিষ্ঠানপ্রধান সম্মতি দিলেই একজন শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষক। এতে জুনিয়র সেকশনের শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন মাধ্যমিকের পরীক্ষক, কলেজের শিক্ষকরাও মাধ্যমিকের পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আবার কোনো শিক্ষক যদি স্বল্প সময়ের জন্যও কোনো একটি বিষয় পড়ান, তাহলেও তিনি ওই বিষয়ে খাতা দেখার আবেদন করতে পারছেন। এক বিষয়ের শিক্ষক হয়েও অন্য বিষয়ের পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
ডিজিটাল ডেটাবেজ করার সময় গাইডলাইন না দিলেও পরীক্ষক হওয়ার জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে। এতে প্রধান পরীক্ষক হতে গেলে কমপক্ষে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। পরীক্ষক হওয়ার জন্য লাগে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া একজন শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফলও পরীক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনার কথা। তবে নীতিমালা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয় না।
কেন শিক্ষকরা খাতা দেখতে চান না– এ নিয়ে অন্তত ১৫ পরীক্ষকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তবে তাদের কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তারা বলেন, পরিশ্রমের তুলনায় খাতা দেখার সম্মানী নামমাত্র। সেটিও পেতে বছর পার হয়ে যায়। এক বছর শেষে আরেকবার খাতা দেখা শুরু হলেও সম্মানী মেলে না। এসব নিয়ে পরীক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, গত বছর তিনি ৪০০ খাতা দেখেছেন। এ বছর ৬০০ খাতা দেখেছেন। তবে গত বছরের টাকা এখনও পাননি। এ রকম অভিযোগ আরও অনেকের। পরীক্ষকরা জানিয়েছেন, প্রতি খাতা দেখার জন্য একজন পরীক্ষককে ৩৫ টাকা করে সম্মানী দেয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সে হিসাবে একজন পরীক্ষক ৪০০ খাতা দেখলে ১৪ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। এ থেকে কর বাবদ ১০ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়।