
প্রায় এক দশক আগের কথা। ঝিনাইদহের মহেশপুরের গৌরীনাথপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলাম বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন পাশের উপজেলা কালীগঞ্জে। সেখান থেকে ফেরার পথে একটি মাঠে তাদের চোখ আটকায়। একটু থেমে তারা দেখেন, খুঁটির সঙ্গে বাঁধা টায়ারের ওপর হাড়ভাঙা গাছের মতো গাছ। এতে ঝুলছে গোলাপি রঙের ফল। কৌতূহল মেটাতে কিছুদিন পর আবারও ওই মাঠে যান নজরুল ও জাহিদুল; জানতে পারেন, এটি ড্রাগন ফল। চাষাবাদের পদ্ধতি জেনে ফিরে তারাও বিদেশি এই ফল চাষের পরিকল্পনা করেন।
এরপর নজরুল-জাহিদুলের হাত ধরে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ বাড়তে থাকে ঝিনাইদহসহ আশপাশের জেলায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথ্য বলছে, ঝিনাইদহে আগে শখের বশে অনেকে ড্রাগন ফল চাষ করতেন। পরে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়। বর্তমানে ঝিনাইদহে ড্রাগন চাষি প্রায় দুই হাজার ২৫৯ জন। গৌরীনাথপুর, আজমপুর, মহেশপুরসহ ঝিনাইদহের সব জায়গায় বছর বছর বাড়ছে ড্রাগনের আবাদ। চলতি বছর জেলায় ড্রাগন আবাদ হয়েছে এক হাজার ২০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে শুধু মহেশপুর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ৩২০ হেক্টর, যা গত বছরের তুলনায় চার হেক্টর বেশি। চাষিরা বলছেন, গৌরীনাথপুর বাজারে মৌসুমের ৬ মাস গড়ে প্রতিদিন আড়াই কোটি টাকার ড্রাগন বিক্রি হয়।
ড্রাগন চাষি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৬ সালে বন্ধুরা মিলে কালীগঞ্জে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ওই উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মাঠের ভেতর ড্রাগন ফল আবাদ করতে দেখি। সেদিন সময় না থাকায় বিস্তারিত না জেনেই বাড়ি ফিরি। কিছু দিন পর আমি আর নজরুল সেখানে যাই। সেখানকার চাষিদের কাছে ড্রাগন চাষের বিষয়ে বিস্তারিত শুনি। এতে আমাদেরও এই ফল চাষের আগ্রহ তৈরি হয়। তখনই দুজন ড্রাগন চাষের পরিকল্পনা করি।’
তিনি জানান, প্রথমে ৩৯ শতক জমিতে ৩৬০টি খুঁটিতে এক হাজার ৪৪০টি চারা রোপণ করেন। নজরুল ইসলামও ১০০টির বেশি খুঁটিতে চাষ করেন। ড্রাগন ফল চাষ করতে দেখে এলাকার মানুষ প্রথমে তাদের পাগল বলতেন। তবে এসব কথা গায়ে মাখেননি তারা।
জাহিদুল বলেন, ‘প্রথম দিকে কোটচাঁদপুর উপজেলার এক ব্যাপারীর মাধ্যমে শহরের বাজারে নিয়ে ড্রাগন ফল বিক্রি করতাম। এতে খরচ বেশি হতো, ক্রেতাও পেতাম কম। নানা কারণে প্রথম বছর তেমন লাভ হয়নি। তবে ধীরে ধীরে লাভ বাড়তে থাকে। বর্তমানে ২২ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করছি। বছরে এক কোটি টাকার বেশি ফল বিক্রি করি। বর্তমানে গৌরীনাথপুরে বাজার হওয়ায় ফল তুলে সঙ্গে সঙ্গে আড়তে নিয়ে বিক্রি করতে পারছি।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে আমি ১৮ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করছি। প্রথমে আমরা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা টায়ারের ওপর চারা রোপণ করতাম। পরে আমি চায়না পদ্ধতিতে চাষ শুরু করি। এই পদ্ধতিতে খুঁটির বদলে মাচা বা বান দেওয়া হয়। ফলে গাছও বেশি রাখা যায়। এতে খরচ কমে অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। লাভও বেশি হয়। এরপর জাহিদুলও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন জেলায় ড্রাগন চাষ বাড়তে থাকে।’
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, সব ধরনের মাটিতেই ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। তবে বেলে দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী। ভাদ্র মাসে চারা রোপণ করলে ভালো; অন্যান্য সময়ও রোপণ করা যায়। এক বিঘা জমিতে পরিচর্যা বাবদ ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ হয়। ফলন ভালো হলে অন্তত চার লাখ টাকার ফল বিক্রি করা যায়। অনেক কৃষক শীতকালে ড্রাগন চাষে লাইট ইনডোর্স পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এতে দিন ও রাতের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হয়ে ফুল ও ফলের সংখ্যা বেড়ে যায়। ঝিনাইদহে রেড ভেলভেট, থাই কিং ও ভিয়েতনামি হাইব্রিড জাতের ড্রাগন চাষ বেশি হয়ে থাকে।
মহেশপুর উপজেলার মালাধরপুর গ্রামের কৃষক ময়নাল হোসেন বলেন, প্রথম বছর চারা রোপণ, খুঁটি পোঁতা, মাটি প্রস্তুত, সার দেওয়াসহ বিঘায় খরচ পড়ে তিন লাখ টাকা। পরের বছরগুলোতে পরিচর্যা খরচ কমে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় নামে।
যার হাত ধরে গৌরীনাথপুরে ড্রাগন বাজার
গৌরীনাথপুরের ড্রাগন বাজারের পরিচিতি দেশজুড়ে। অনেকে একে ‘ড্রাগনের রাজধানী’ বলে থাকেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এসে ফল কেনেন। বর্তমানে বাজারটিতে বছরে প্রায় ৫৪০ কোটি টাকার ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারের শুরু স্থানীয় ড্রাগন চাষি ও ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিনের হাত ধরে।
জসিম জানান, এক সময় ড্রাগন বেচতে কৃষকদের যেতে হতো কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ ও যশোরের বিভিন্ন বাজারে। পাইকাররাও ঠিকমতো আসতেন না। ফলে কৃষকের বাড়তি খরচ হতো। এ ছাড়া পরিবহন ও বাজারজাতের করণে সময় বেশি লাগায় ফলের মান খারাপ হতো। এসব চিন্তা করে তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে গৌরীনাথপুরে ড্রাগন বাজার স্থাপনের পরিকল্পনা নেন। প্রথম ২০২১ সালে তিনি সিয়াম-তাসিন ফল ভান্ডার খোলেন। তাঁর আড়ত দেখে হক ফল ভান্ডার, সরকার ফল ভান্ডার ও বাশার ফল ভান্ডার স্থাপন হয়। বাজারটিতে ২০২২ সালে ৪০টি আড়ত গড়ে ওঠে। বর্তমানে আড়তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮-এ।
গৌরীনাথপুরে এক দিন
ভোর থেকে শুরু হয় চাষিদের কাজ। ক্ষেত থেকে কেটে ড্রাগন নিয়ে পাইকারি বাজারে হাজির হন কৃষকরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা, পাইকারদের সমাগম বাড়তে থাকে। প্রতিটি আড়তে গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন কাজ করেন। মূলত ড্রাগন ফলের মৌসুম এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস। বাকি সময়টা তুলনামূলক উৎপাদন কম, বিক্রিও কম।
সিয়াম-তাসিন ফল ভান্ডারের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, এই বাজারে মৌসুমের ৬ মাস গড়ে প্রতিদিন আড়াই কোটি টাকার ড্রাগন বিক্রি হয়। বাকি ৬ মাস গড়ে প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকা বিক্রি হয়। প্রায় ৬৪ জেলার পাইকাররা এসে ফল কিনতে পারেন। বেচা-বিক্রি, লেনদেন স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হয়।
হক ফল ভান্ডারের মালিক নাজমুল হক বলেন, ন্যায্য দামে কৃষকের ফল পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিই নির্ধারিত কমিশনে। সব দিক দিয়ে স্বচ্ছতার কারণে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বাজারটি। ভাটপাড়া গ্রামের চাষি হজরত আলী জানান, তিনি ১৪৭ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি করেছেন।
মহেশপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, খরচের তুলনায় লাভ ও চাহিদা বেশি থাকায় ড্রাগনের চাষ বাড়ছে। বাজার আরও সম্প্রসারণ ও কৃষকরা যেন ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেন এ জন্য কৃষি বিভাগ নিয়মিত বাজারটিতে খোঁজখবর রাখছে।
সূত্রঃ সমকাল