” দীপান্বিত গুরুকুল”- একটি পুস্তক পর্যালোচনা; পর্ব -৩ স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » ” দীপান্বিত গুরুকুল”- একটি পুস্তক পর্যালোচনা; পর্ব -৩ স্বপন চক্রবর্তী
বুধবার ● ২৪ আগস্ট ২০২২


   স্বপন কুমার চক্রবর্তী
গুরুকুলের প্রতি শিক্ষাঋণের স্বীকারোক্তি ও অনুকরণীয় শ্রদ্ধা নিবেদন: পর্ব-৩

দেশবরেণ্য শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান ১৪ মে ২০২০ মৃত্যু বরণ করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। ফলে তাঁর সম্মানে তেমন কোন সমাবেশ করা যায়নি। করোনা-আতঙ্কগ্রস্থ দেশবাসীর মতো আমরাও অত্যন্ত আহত হয়েছিলাম। এ ব্যপারে লেখক দু;একটি লাইনে তাঁর প্রিয় শিক্ষকের বিয়োগ ব্যাথা প্রকাশ করেছেন এ ভাবে, “ পৃথিবীর অনাদিকালের নিয়ম মেনে স্বজনেরা তাদের পরম প্রিয়জনের মুখটাও দেখতে পেলেন না। নদীর স্রোতধারার মত অযুত অশ্রুর সামান্য কয়েক ফোঁটা ঝড়ে গড়ালো করোনাকালে বিচ্ছিন্ন সব দ্বীপবাসী অনুরাগীর চোখে। স্যারের মৃত্যু নেই,মৃত্যু হতে পারে না। স্যার আজও আমার অভিভাবক , আমি আমৃত্যু স্যারের স্নেহ-ছায়ায় ভালোবাসা ও আশীর্বাদে বেঁচে থাকতে চাই”।– হৃদয় স্পর্শ করে যায় এ কথাগুলো। আমারা তাঁর ছাত্র হবার সৌভাগ্য অর্জন করিনি বটে, তবে আমরা একান্ত গুরুবৎ তাঁর প্রতিটি কথা শুনেছি এবং হৃদয়ে গেঁথেছি । জাতি তাঁর অমৃতবাণী শুনার জন্য উদ্গ্রীব থেকেছে। তাঁর কতটুকু যোগ্য ছাত্র হলে লেখকের এমন অনুভুতি প্রকাশিত হতে পারে জানিনা। আর কত যোগ্য শিক্ষক হলে একজন ছাত্রের এমন উপলব্ধিতে আসে। লেখক তাঁর শিক্ষক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে যথার্থ বলেছেন, “ সে ( তাঁর ) কর্মের ফিরিস্তি এক কথায় মুল্যায়ন করা সম্ভব নয়; এক জীবনেও নয়। শিক্ষাবিদ, লেখক ,গবেষক, ইতিহাসবিদ, সম্পাদক,সংকলক, সংগঠক, অধিনায়ক,সমাজবিদ, মানব হিতৈষী , মুক্তিযোদ্ধা, সংবিধান প্রণেতা, প্রতিবাদী, প্রতিরোধী, উপদেশক- এক জীবনে কত যে ভূমিকা তাঁর কত যে কীর্তি।” এখানেও লেখক তাঁর লেখনী শৈলীর সক্ষমতায় সাগরসম বিস্তৃত গুণের অধিকারী মানুষটাকে মূল্যায়নে পারঙ্গম হয়েছেন। আমরাও আমাদের জাতীয় গুরুর গুণ গুলো সম্পর্কে একত্রে স্মরণ করতে সক্ষম হলাম।
বইটি পড়ে আমি খুব তৃপ্তি পেলাম। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁর অশেষ গুণ সম্পর্কে নানান ধারনায় সমৃদ্ধ তাঁর প্রজ্বলিত দীপশিখা সম্পর্কেও আশান্বিত হলাম। এই জন্য তিনি ( শিক্ষাবিদ) ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক আরও বলেছেন, “মানব জীবনে অনেক ধরনের ঋণ আছে- দেবঋণ, ঋষিঋণ, মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, গুরুঋণ, ইত্যাদি। এর ভিতরে পিতা-মাতা এবং শিক্ষা গুরুর ঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না। “ এই অবক্ষয় এবং শিক্ষক অবহেলিত সময়ে লেখাগুলো খুব প্রয়োজনীয়। ইদানীং কালে ক্রমাগতভাবে শিক্ষকদের যে ভাবে লাঞ্চিত করা হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে ,তাতে হতাশ হয়ে যাই। আর ভাবি, এমন শিক্ষক আর এমন ছাত্র তৈরী কি বন্ধাত্বের পর্যায়ে চলে যাবে ? প্রসঙ্গত একটু বলতে ইচ্ছে হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখেছি বাংলা একাডেমীর বই মেলা উদ্বোধন কালে তাঁর সম্মানে বিছানো লাল গালিচা তিনি মাড়িয়ে যান নি, তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁরই প্রিয় শিক্ষক এই আনিসুজ্জামানকে। শেখ হাসিনাও যে এই পরশ পাথরের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

( শ্রেষ্ঠ সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়- ১৯৭২-৭৭ )
এই সময়টিকে লেখক শ্রেষ্ঠ সময় বলেছেন। সে সময় যারা ছাত্র হিসেবে যোগদান করে ছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারাও স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন। এই সময় শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ সময় নয়, পুরো জাতির জন্য একটা মহেন্দ্রযোগ বলা যায়।
বইটিতে যে সব মনীষির প্রতি লেখক শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি এবং উপযুক্ত শব্দাবলী আমার ভান্ডারে নেই। শুধু তাঁদের মহৎ গুণের সম্পর্কে জেনেছি আর কিছুটা ঋদ্ধ হয়েছি। এক জনের চেয়ে আর এক জন কম যায় না। কেহ কারো চেয়ে কম বা বেশী গুণী কিনা তা আঁচ করার ক্ষমতা আমার নেই।
লেখক তাঁর প্রিয় শিক্ষক ড.মনিরুজ্জামান সম্পর্কে একটি কবিতা লিখেছিলেন- যা এই বইটিতে সন্নিবেশিত আছে। তা থেকে ক;টি লাইন উদ্ধৃত করতে চাই।
“ সময়টা উনিশ’ বাহাত্তর সাল-
অর্বাচীন বালকের কাছে তোরঙ্গে তোরঙ্গে ভরা সোনার মোহর
কোনটা ফেলে আমি কোনটা রাখি,
একটা আর একটার চেয়ে দীপ্তিময় বর্ণময় সমুজ্জ্বল”।
- এই লাইন ক’টিতে সকল শিক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠেছে। এটিই লেখকের কাব্যিক সক্ষমতা। কি এক শুভক্ষণে গুণীসব শিক্ষক আর ছাত্র –ছাত্রী মিলিত হয়ে ছিলেন তীর্থভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এত সব নামের ভীড়ে কোন নাম ও মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা করবো ? তাই আমাকেও বলতে হচ্ছে-
” কোনটা ফেলে আমি কোনটা রাখি”।
ড. মনিরুজ্জামানের অকাল প্রয়াত কন্যা দোলার মৃত্যু হয় ১৯৮৮ সালে। তিনি লেখকের কন্যা শ্রাবনী সেনের মধ্যে নিজ কন্যার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন। উদীয়মান সু-সাহিত্যিক সংগঠক ও সংস্কৃতিমনা সেই কন্যা শ্রাবনী সেনও পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তার পরম আরাধ্য ধামে চলে যায়। এটা প্রচন্ড একটা আঘাত। তথাপী লেখক নিজ মহত্বের গুনে সেই শোক সংবরণ করে গেছেন। শুধু লিখেছেন, ” ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, স্যারের দোলার মতো আমার কন্যা শ্রাবনী সেনও ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর নক্ষত্র লোকের যাত্রী হয়ে না ফেরার দেশে চলে যায় “। পড়তে পড়তে আমিও আমার মনের অজান্তে চোখে দু’ফোটা জল অনুভব করলাম।

কাজী নজরুলের পুত্র বুলবুলের মৃত্যুতে তিনি ব্যাকুল হন। এতো কঠোর ও চির সংগ্রামী নজরুল মৃত বুলবুলের জন্য এতটাই বিচলিত ছিলেন যে, তিনি পুত্রকে এক নজর সশরীরে দেখতে উদ্গ্রিব হয়ে পড়েন। নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতেন এবং হাসির গান লিখতে চেষ্টা করতেন। শেষে গৃহযোগী লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বরদাচরণ মজুমদারের নিকট কালীমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ছিলেন এবং আরাধনা করেছিলেন। তিনি নাকি ছেলের দেখাও পেয়ে ছিলেন। যাক সে কথা। কিন্তু এই লেখক এবং তাঁর শিক্ষক ড. মনিরুজ্জামান কি ভাবে সন্তানের এই অকাল প্রয়াণ সহ্য করেছেন তা জানি না। শুধু তাদের বিদেহী আত্মার পরম শান্তি কামনা করা ছাড়া এখন আমাদের আর কি বা করার আছে।
অভিনবভাবে বইটিতে আরও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন তাঁর শিক্ষক আবু হেনা মোস্তফা কামালকে, শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ড. জাহাঙ্গীর তারেককে এবং তাঁর অন্যসব শিক্ষক ও সতীর্থদেরকে।
বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। কালো এবং সাদা বর্ণের দোয়াত ও পালকের কলম ব্যবহার করা হয়েছে। পরিষ্কার স্বচ্ছ ছাপায় মুদ্রিত ও উন্নত মানের কাগজে ( অফসেট) বইটি বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত । এই মূল্যবান বইটিতে ব্যবহৃত দুর্লভ ছবিগুলো যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে রঙিন কালারে করা গেলে আরও আকর্ষণীয় হতো। সুন্দর ঝকঝকে ছাপায় সহজ সরল উপস্থাপনে শিক্ষা গুরুর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো অতলস্পর্শী শ্রদ্ধায় পূর্ণ এবং সুখপাঠ্য এই বইটি সংরক্ষণ করার মতো ও প্রিয়জনকে উপহার দেবার যোগ্য একটি বই।
( দীপান্বিত গুরুকুল নিয়ে আমার অভিব্যাক্তি এখানেই শেষ, তবে বইটির বাইরে প্রাসঙ্গিক ভাবে গুরুভক্তির দু”একটি কথা বলতে ইচ্ছে হয়। আগামী পর্বে চেষ্টা থাকবে। )

বাংলাদেশ সময়: ২০:১১:১৯ ● ৪২৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ