সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৫১ :স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৫১ :স্বপন চক্রবর্তী
সোমবার ● ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩


ফাইল ছবি-কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল; বহু বিশ্রুত ও বিস্ময়কর এক প্রতিভা: পর্ব-৬
বিকেলে এসে রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে “ গুরুজী গুরুজী “ বলে চেঁচাতে থাকি। ওপর থেকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, কি কাজী অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন, কি হয়েছে”। “ আপনাকে হত্যা করবো, গুরুজী , আপনাকে হত্যা করবো”। “ হত্যা করবো, হত্যা করবো” কি , ওপরে উঠে এসে বসো। “ হ্যাঁ সত্যিই বলছি, আপনাকে হত্যা করবো, বসুন শুনুন । “ কাজী তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি সহকারে “ বিজলী” হাতে নিয়ে উচ্চস্বরে “ বিদ্রাহী” তাঁকে শুনিয়ে দিল। তিনি স্তব্দ বিষ্ময়ে কাজীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে কাজীকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন, বললেন, “হ্যাঁ ,কাজী তুমি আমায় সত্যি হত্যা করবে”।
“ বিদ্রোহী” কবিতাটি “বিজলী’ এবং ”মুসলেম ভারত” ছাড়াও মাঘ সংখ্যা ”প্রবাসী”তে এবং আরও কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। এ কবিতা প্রকাশ মাত্র সাড়া পড়ে যায় এবং নজরুল “ বিদ্রোহী” কবি খ্যাতি লাভ করেন। ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ১৯২১ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নজরুলের “ শাত-ইল- আরব” “ খেয়া পারের তরণী’ ” কোরবানী” “ মোহররম” ফাতেহা-ই- দোয়াজ-দহম” “ আনোয়ার” ”কামাল পাশা” “বিদ্রোহ “ রচিত হয়।
” বিদ্রোহী “ কবিতার জন্যে নিরবচ্ছিন্ন প্রশংসা আর অভিনন্দনই নজরুলের জোটে নি, নজরুলের সাফল্য ও খ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ কেউ নজরুলের সমালোচনায় মুখর হন।
নজরুলের ”ভাঙ্গার গান” “ বিদ্রোহীর “ সমসাময়িক রচনা , দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী দেশবন্ধুর সাপ্তাহিক পত্রিকা “ বাঙলার কথা”র জন্য লেখা চেয়ে সুকুমার রঞ্জন দাসকে নজরুলের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি নজরুলকে দেখতে চেয়ে নিমন্ত্রণও করেছিলেন। বাসন্তী দেবীর অনুরোধ নিয়ে সুকুমার দাস এলে তাকে বসিয়ে রেখে নজরুল সঙ্গে সঙ্গে “ ভাঙ্গার গান” রচনা করে দেন। নজরুল বাসন্তী দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং পরে তাঁর স্নেহের স্বীকৃতি স্বরূপ “ চিত্তনামা” কাব্যগ্রন্থটি বাসন্তী দেবীকে উৎসর্গ করেন। অনেকের ধারণা “ভাঙ্গার গান” বা কারার ঐ লৌহ কপাট “নজরুলের কারা জীবনে রচিত, সে ধারণা যথার্থ নয়। ১৯২১ খ্রীস্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর থেকে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দের ২০ শে জানুয়ারীর পূর্বে “ ভাঙ্গার গান” রচিত এবং ২০শে জানুয়ারী “ বাঙ্গলার কথায়” তা প্রকাশিত। নজরুল কারাবরণ করেছিলেন আরও এক বছর পরে।
১৯২২ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে নজরুল চতুর্থবার কুমিল্লায় যান এবং প্রায় চার মাস কুমিল্লায় অবস্থান করেন। এ বারে কুমিল্লা অবস্থান কালে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মানিকগঞ্জ জেলার তেওতা গ্রামে প্রমীলার জন্ম, তার বাল্য নাম আশালতা সেনগুপ্তা, ডাকনাম দোলনা দেবী , সংক্ষেপে দুলী। প্রমীলার পিতা বসন্তকুমার সেনগুপ্ত , তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েবের চাকুরী করতেন। প্রমীলার পিতার মৃত্যুর পরে মাতা গিরিবালা শিশু প্রমীলাকে নিয়ে কুমিল্লার বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের ভ্রাতা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের আশ্রয়ে বসবাস করতে থাকেন। নজরুল চতুর্থবার কুমিল্লায় এসে প্রমীলার উদ্দেশ্যে “বিজয়িনী” কবিতাটি রচনা করেন ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে। “ বিজয়িনী” আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চুড়ে “ চরণ থেকে বোঝা যায় কবিতাটি” “ বিদ্রোহী কবিতার পরে রচিত।
” বঙ্গীয়” মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার ‘ মাঘ সংখ্যায় নজরুলের “ নিশীত প্রীতম” “ সহচর” পত্রিকার ফাগুন সংখ্যায় “অভিমানী” এবং ”প্রবাসীর” চৈত্র সংখ্যায় “ আরবী ছন্দের কবিতা প্রকাশিত হয়। নজরুলের প্রথম গ্রন্থ “ ব্যাথার দান” প্রকাশিত হয় ১৩২৮ সালে ফাগুন মাসে ( ১লা মার্চ, ১৯২২ খ্রীঃ) ,প্রকাশক এম আফজালুল হক, মুসলিম পাবলিশিং হাউস , কলেজ স্কোয়ার কলিকাতা, পৃষ্ঠা ১৪৭, মূল্য দেড় টাকা। প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ১১০০ কপি। মুজফ্ফর আহমদের কাছ থেকে জানা যায়, নজরুল মাত্র একশত টাকার বিণিময়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ গল্প সংকলন “ব্যাথার দান” এর সত্ব আফজালুল হক সাহেবকে দান করে ছিলেন। অথচ “ ব্যাথার দান” প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যেই নজরুলকে মাত্র কুড়ি টাকার জন্য আফজালুল হককে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ শে মার্চ “ভাই ডাবজল” সম্বোধনে অনুনয় করে একটি পত্র লিখেন।
নজরুলের অন্যতম বিখ্যাত কবিতা “প্রলয়োল্লাস” কুমিল্লায় ১৩২৯ সালের বাংলা নববর্ষের সময় ( এপ্রিল, ১৯২২ খ্রীঃ ) রচিত। এই কবিতাটির রচনাকাল সম্পর্কে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের প্রচার বিভাগ কর্তৃক ১৯৫৬-৫৭ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত মন্মথ রায় প্রযোজিত “ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম “ তথ্য চিত্রে এবং আজহার উদ্দীন খানের “ বাংলা সাহিত্যে নজরুল” ( চতুর্থ সংস্করণ, আশ্বিন, ১৩৬৯) ,সুনীল কুমার গুপ্তের “নজরুল চরিত মানস” ( ভারতী সংস্করণ, আশ্বিন, ১৩৭০) গ্রন্থে ভ্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে যে, “প্রলয়োল্লাস” ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ প্রস্তাবের পটভূমিকায় রচিত। প্রকৃত পক্ষে “প্রলয়োল্লাস” কুমিল্লায় ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে লিখা।
নজরুল ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসের শেষের দিকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে মওলানা আকরম খানের “ দৈনিক সেবক “ পত্রিকায় যোগদান করেন। নজরুল যখন “ সেবক” পত্রিকায় কাজ করছিলেন, তখন ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে জুন ( ১০ই আষাঢ়,১৩২৯ সাল ) কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একচল্লিশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর প্রিয় কবির মৃত্যুতে নজরুল “সেবক” পত্রিকার জন্য একটি দীর্ঘ আবেগপূর্ণ সম্পাদকীয় লিখেন। প্রকাশক যে পরের দিন পরিবর্তিত আকারে সম্পাদকীয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল “ সেবক” পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সম্পাদকীয়টির পরিবর্তন সাধন করেছিলেন “সেবকের” মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এবং আবুল কালাম শামছুদ্দীন।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যে দিন মারা যান ( ২৫মে জুন ,১৯২২ ) সেদিন সন্ধায় কলেজ স্কোয়ারে স্টুডেন্ট হলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শোক সভার জন্যে নজরুল “ চল চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিলে পথ ভুলে” গানটি রচনা করে তা সভায় গেয়েছিলেন, ( বসুমতি, শ্রাবণ ,১৩২৯ ) । ””ভারতী” পত্রিকার সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত স্মৃতি সংখ্যা (শ্রাবণ,১৩৯১ ) র জন্য তিনি রচনা করেন “ কবি সত্যেন্দ্র “ নামে কবিতাটি , যার প্রথম চরণ “ অসত্য যত রহিল পড়িয়া সত্য সে গেল চলে”। নজরুল “সত্যেন্দ্র” প্রয়াণ নামে আরও একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছিলেন, যার শুরু “ আজ আষাঢ় মেঘের কালো কাফনের আড়ালে মুখখানি ঢাকি” কবিতাটি “বিজলী” পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৬ই আষাঢ় ১৩২৯ সাল ( ৩০শে জুন ,১৯২২ খ্রীঃ)। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মারা যান ১০ই আষাঢ় , অথচ “ ফণিমনসা” গ্রন্থে কবিতাটির রচনাকাল দেওয়া আছে “শ্রাবণ ,১৩২৯ “, এ তারিখ সঠিক নয়। “ফণিমনসা” গ্রন্থে সংকলিত “ সত্যেন্দ্র প্রয়াণ গীতির “ রচনা কাল উল্লিখিত ”শ্রাবণ ১৩২৯ “, অথচ গানটি নজরুল ১০ই আষাঢ়, শোকসভায় গেয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঐ তিনটি রচনা এবং পুর্বাহ্নে রচিত “ দিল দরদী” কবিতা ”ফণিমনসা” গ্রন্থে সংকলিত। ( চলবে )
( অনেক কথাই একাধিক বার এসে গেছে। বিভিন্ন উদ্ধৃতি হবহু উল্লেখ করতে গিয়ে এমনটি হচ্ছে। )

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৪৩:৫২ ● ৩৪০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ