রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন, পর্ব: ৩২৩ বাদুড়তলা শাখা ,বগুড়া

Home Page » সাহিত্য » রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন, পর্ব: ৩২৩ বাদুড়তলা শাখা ,বগুড়া
রবিবার ● ৫ নভেম্বর ২০২৩


জালাল উদ্দীন মাহমুদ

একজন দুরূহ কর্মী-১
বাদুড়তলা। বগুড়া শহরের অতি পুরাতন জনবহুল একটি এলাকা। এখানে অগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখা আছে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে সেখানে একদিন বদলির অর্ডার পেলাম। ১৯৯৩ সালের মে মাসে ম্যানেজার হিসেবে অগ্রণী ব্যাংকের বাদুড়তলা শাখায় যোগদান করলাম। চার বছরেরও একটু বেশি সময় এ শাখায় ছিলাম।
যোগদান করেই এ শাখার যে বিষয়টি আমার নজরে আসল তাহলো শাখার স্টাফ পজিশন।
নন ব্যাংকিং গুণ সম্পন্ন এত বিচিত্র ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমাবেশ ব্যাংকের এ শাখায় কেমনে ঘটেছিল তা এতা বছর পরে এখনও আমার কাছে এক বিশাল গবেষণার বিষয়।
আমি যোগদানের সময় শাখার ম্যানেজার ছিলেন দুলাল ভাই। যার কথা আমার বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে বলেছি। সহজ-সরল সাধাসিধা ভদ্রলোক। কারো সাতেও নেই পাচেঁও নেই। তার চোখে জগতের কোনো কিছুই , কোনো কেহই খারাপ নয়।
জোনাল হেড তাগাদা দিচ্ছিল- আমি যেন তাড়াতাড়ি শাখার বর্তমান ম্যানেজার মহসীন আলী খন্দকার তথা দুলাল ভাইয়ের নিকট থেকে চার্জ বুঝে নিয়ে তাকে রিলিজ করে দেই। কিন্তু কে চার্জ বুঝে দিবে? দুলাল ভাইয়ের মধ্যে কোনও ভাবান্তর তো দেখছি না। তাকে বগুড়া শহরের আর একটি শাখায় ম্যানেজার হিসেবে বদলি করা হয়েছে। আমাকে চার্জ বুঝে দিয়ে তাকে যে অন্য একটি শাখায় যোগদান করতে হবে –এ ব্যাপারে তার মধ্যে লেশমাত্র ভাবান্তর নেই। জগৎ চলছে জগতের নিয়মে আর দুলাল ভাই চলছে আগের নিয়মে। আমি যে একজন তার সামনে বসে আছি সব কিছু বুঝে নেবার জন্য –এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ন উদাসীন।আমার শত তাগাতেও কাজ হচ্ছে না।
পাকিস্তান আমলে গোডাউন কিপার হিসাবে ব্যাংকে যোগদান করে দুলাল ভাই এখন প্রিন্সিপাল অফিসার। জীবনে বোধহয় এর চেয়ে বেশি কিছু সে চায় নাই ।জীবনের আর কোনও লক্ষ্যও নাই । জীবনের লক্ষ্য না থাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হল,সে সারা জীবন মাঠের ভেতরে দৌড়েও গোল দিতে পারে না । গোল দেবার কোনও লক্ষ্যও দুলাল সাহেবের মধ্যে ছিল না।
তিনি অবশ্য অত্যন্ত মিশুক ছিলেন। সবার সাথে যেচে যেচে কথা বলতেন। তবে কাজ কামের তেমন ধার ধারতেন না। ঠিক তার উল্টা ছিল দ্বিতীয় কর্মকর্তা তবারক আলী সাহেব । ১৯৭৮ সালের দিকে করণিক পদে যোগদান করে এখন সে কর্মকর্তা । ঐ যে সকাল ৮ টা কি ৮.৩০ এর দিকে এসে তবারক আলী সাহেব চেয়ারে বসতেন-তো বসতেনই। ওঠার নাম নাই। এক মনে এক ধ্যানে শুধু কাজই করে যেতেন। কুসুমকুমারী দাশ লিখেছিলেন, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। তবারক সাহেবকে দেখে আমার মনে হয়েছিল সেই ছেলের জন্ম অনেক আগেই হয়েছিল।
তার কারো সাথে তেমন কোন কথা বার্তাও নাই শুধু একটা বিষয় ছাড়া। এ একটা বিষয় হলো –কাস্টমার হোক বা ম্যানেজার সাহেবই কেউ যদি শাখার কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সাথে খারাপ আচরণ করে তা ন্যায্য আর অন্যায্যই হোক তবারক সাহেব কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পক্ষ নিয়ে তার প্রতিবাদ করবেই। তবে প্রতিবাদ করত মৃদ –অনুচ্চ ভাষায় । অনেকটা মনে মনে গজগজ করার মতো। ভালো করে খেয়াল না করলে তা বোঝা যেত না।
ম্যানেজার এবং সেকেন্ড অফিসারের মধ্যে মিলও ছিল –তারা দুজনই একদম সৎ আর ভালো মানুষ ছিলেন তবে প্রশাসনের বিষয়ে শতভাগ উদাসীন । তাদের এ উদাসীনতার জন্যই বোধ হয় কর্মচারীদের মধ্যে এক অদ্ভুত মানসিকতা তৈরী হয়েছিল। এজন্য অবশ্য অন্যতম দায়ী ব্যক্তি শাখার লেজার কিপার টাইপিস্ট কাম ক্লার্ক তোজাম্মেল। নামের শেষে মেল থাকলেও সে একেবারে লোকাল। ব্যাংকের কাছেই বাড়ি। সে ভালো না খারাপ ,পাগল না ছাগল বোকা না চালাক তা এ জীবনে নির্ণয় করতে পারিনি। তার সব ঘটনা শোনার পর বিজ্ঞ পাঠকদের প্রতি তা নির্ণয়ের দ্বায়িত্ব প্রদান করলাম। তবে আজ আমি এটা বুঝতে পারছি যে শুধু ম্যানেজার বা সেকেন্ড অফিসারের উদাসীনতা ছাড়াও তোজাম্মেলের অবিশ্বাস্য আর বিচিত্রধর্মী ফাঁকিবাজিও এ ব্যাংক শাখার অন্যান্য কর্মচারীদের কর্মবিমুখ বানাতে সহায়তা করেছিল।
অফিস আর কাজে ফাঁকি দিতে তোজাম্মেল যে সব অদ্ভুত পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিল তার তুলনা কার সাথে দিব এমন কিছু খুজেঁ পাচ্ছি না। তাকে নিয়ে লেখা ঘটনা গুলি ব্যাংকিং জগতে আলিফ লায়লার পর্বের চেয়েও আকর্ষনীয় হতে পারে। সে সময় আমার মুখ থেকে শুনতে শুনতে বগুড়ার অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় সবারই তার কাহিনি মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আশা করি পাঠকদেরও মনের অজান্তেই তা মুখস্ত হয়ে যাবে।
আমি বাদুড়তলায় যোগদানের আগেই বগুড়ার বেশ কয়েকজন কর্মচারী আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বলেছিল-ওখানে তোজাম্মেল নামে এক পাগলা আছে। টাইপিস্ট কাম ক্লার্ক। আমি যেন তাকে মুখ না দেই। আমি জানতে চাইলাম-একদম পাগলা?
সে বলল- পাগল না ছাগল , ভালো না মন্দ , ঠান্ডা না গরম কিছুই বোঝা যায় না।
তোজাম্মেল তা হলে কোন পদের লোক ?
-সে কোনও পদের মধ্যেই পড়ে না । আপনি তার সাথে কয়েকদিন কাজ করলেই বুঝতে পারবেন স্যার। তবে সে নেতা-টেতা না।
একজন বলল-ওসব পাগল টাগল কিছু না-ও হলো তিনডার পাগল।
-তিনডার পাগল?
-হ্যাঁ, তিনডার পাগল। তিনডার পাগল বুঝলেন না স্যার। তা হলে খুলেই বলি গল্পটা।
এক লোক পাশের দোকান থেকে এক হালি ডিম কেনার পর ঠোঙা খুলে গুনে দেখে সেখানে ৪টার পরিবর্তে ৩টি ডিম আছে। লোকটি দোকানদারকে বললো, ভাই দাম নিলেন ৪ টার, দিলেন ৩টা, এর কারন কি?
দোকানদার বললো, ভাই আমি একটা পাগল-ছাগল মানুষ, মাফ করে দেন। ১টা ডিম দিয়ে দিচ্ছি।
লোকটা বললো পাগলই যদি হন তাহলে ৫টি ডিম দিলেন না কেন?
দোকানদার বললো-আমি অতদূর পাগল না ভাই যে ৪টা কিনলে ৫টা দিয়ে দিব।
লোকটা বললো,-“ও তাহলে আপনি ৩টার পাগল”। সেই থেকে এ কিসিমের পাগলকে ৩টার পাগল বলে।
৩টার পাগল যাকে বলে বলুক । আমার মাথায় তখন একটা চিন্তা। তোজাম্মেল লোকটা আসলে কেমন হবে ? তাকে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকলাম।
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল

বাংলাদেশ সময়: ১১:২০:৫০ ● ১৮০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ