ফারহানা আকতার এর কলাম – “নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব-৬১”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব-৬১”
সোমবার ● ১৩ ডিসেম্বর ২০২১


নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব-৬১

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা নাটক শেষে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সেদিন সন্ধ্যাবেলায় লুকিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেছেন।তাকে বহনকারী বিমানটি কলম্বো আর করাচির মাঝপথে থাকাকালীন সময়ে তিনি বলেছিলেন, সেটি করাচি না পৌঁছনো পর্যন্ত অ্যাকশন শুরু করা যাবে না।
কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার কাজটা শুরু হবে ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত একটা থেকে। কিন্তু রাত সাড়ে ১১টা থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর অধিনায়করা উত্তেজিত এবং প্রস্তুত। তারা ‘এইচ-আওয়ার’ অর্থাৎ হামলার নির্ধারিত সময়টি এগিয়ে আনার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে সেই রাতে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিক। তিনি তার লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার বই’ তে জানিয়েছেন, “রাত সাড়ে এগারটা থেকে ওয়্যারলেসগুলো সচল হয়ে উঠলো। নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হলো হামলা। খুলে গেল দোজখের দরোজা”৷

সেনাবাহিনীর নিয়মমাফিক কোম্পানিতে নেতৃত্ব দেয়ার কথা একজন মেজর পদমর্যাদার অফিসারের। কিন্তু শেখ মুজিবকে আটকের দায়িত্ব পাওয়া স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) ৩ কমান্ডো কোম্পানিতে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল জেড এ খান এবং কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর বিলাল রানা আহমেদ।

এসএসজি কমান্ডোরা যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল তখন তখন বাড়ির রক্ষীরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। কমান্ডোরা দ্রুত এদের থামিয়ে দেয়। একজন অস্বীকার করলে তাকে হত্যা করা হয়।বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথেই ৫০ কমান্ডো স্টেনগান দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ শুরু করে। তারা চিৎকার করে শেখ মুজিবকে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে তারা দোতলায় উঠে আসে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব তার গ্রেফতারের সেই মুহূর্তগুলির বর্ণনা দিয়েছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সিডনি শনবার্গকে। সেই পত্রিকায় শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল ৷ সেখানে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “গোলাগুলি শুরু হলে আমি সবাইকে নিয়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। তারপর যখন সিঁড়িতে তাদের পায়ের শব্দ পাই, তখন দরোজা খুলে জানতে চাই: ‘গুলি থামাও, গুলি থামাও। কেন তোমরা গুলি করছো? আমাকে যদি মারতে চাও আমি তো এখানেই রয়েছি। কেন তোমরা আমার লোকজনকে মারছো?”পাকিস্তানি সৈন্যরা এরপরও গুলি চালালে, মেজর বিলাল তাদের থামায় এবং শেখ মুজিবকে জানায় যে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এরপর শেখ মুজিব পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেন।

তাদের তিনি বলেন: “আমাকে হয়তো ওরা মেরে ফেলবে। ফিরে আসতে পারবো কিনা জানি না। কিন্তু কোন একদিন আমাদের দেশের মানুষ মুক্ত হবে। তখন আমার আত্মা তা দেখে খুশি হবে।” একথা বলে তিনি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান।
কিন্তু পাক সেনাবাহিনীর জিপে উঠতে গিয়ে শেষ মুজিব হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। তিনি তার আটককারীদের বলেন, “আমি আমার পাইপ আর তামাক ফেলে এসেছি। পাইপ আমার লাগবেই।” তার কথা শুনে সৈন্যরা থমকে যায়। এরপর তারা তাকে ঘিরে আবার বাড়িতে ফিরে এলে বেগম মুজিব-বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা সেই পাইপ আর তামাক স্বামীকে এগিয়ে দেন।
এরপর এসএসজির দলটি বাড়ির সবাইকে আটক করে গৃহবন্দী করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর জিপে চড়িয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে ৷
পশ্চিম পাকিস্তানের সিদ্দিক সালিক লিখছেন, “এর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওয়্যারলেসে ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর জাফরের গলার শব্দ শোনা যায়। পরিষ্কার গলায় সে জানায়, “বিগ বার্ড (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) ইন দ্যা কেজ ………..… অন্যান্য পাখিরা নীড়ে নেই, ওভার “৷
সিডনির শনবার্গ লিখছেন, “ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিব রাখা হয়েছিল আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ‘একটি নোংরা অন্ধকার ঘরে’ এবং পরের দিন তাকে সরিয়ে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে’।আটক শেখ মুজিবকে নিয়ে একটি বিমান পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ১লা এপ্রিল। বিমানটি করাচিতে নামার পর সেখান থেকে আরেকটি বিমানে তাকে সরিয়ে নেয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে, এবং শেষ পর্যন্ত তার জায়গা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর পাঞ্জাবের শহর মিয়াওয়ালির কারাগারের এক প্রকোষ্ঠে যেখানে সাধারণত রাখা হতো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের।এরপর পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিবের বন্দিজীবনের বিস্তারিত খুব একটা জানা যায় না। পাশাপাশি সামরিক শাসনের মধ্যে দেশের সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠও ছিল রুদ্ধ। তার মাঝে মিয়াওয়ালির জেলের এক অন্ধকার সেলে আটক শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে কেউই খুব একটা চিন্তিত ছিল না। তবে তার বন্দিদশা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় বহু পরে। কিছু তথ্য পাওয়া যায় বিদেশি পত্রপত্রিকা থেকে। আর কিছু তথ্য পাওয়া যায় কয়েক দশক পর যখন এমনকি শেখ মুজিব নিজেও ততদিনে বেঁচে নেই”।

করাচির ( পশ্চিম পাকিস্তান) ডন পত্রিকায় ১০ই অগাস্ট এক খবরে বলা হয়, “পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে এক প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে এক বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবকে বিচার করা হবে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে –‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা’। বিচারটি গোপনে হবে এবং এর বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে না বলে প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়”। এর এক সপ্তাহ পর, নিউইয়র্ক টাইমস ঢাকা ডেটলাইনে এক খবর প্রকাশ করে, যেখানে জানানো হয় তার এক সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবের গোপন বিচার শুরু হয়েছে।প্রকৃতপক্ষে, পাক সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে মোট বেশ কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করে। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

পুর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান (২৫ মার্চ’১৯৭১) শুরুর দু’দিন পর শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর তৎকালীন সরকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেছিল।
বাংলাদেশ যেদিন (১৬ ডিসেম্বর’১৯৭১) স্বাধীন হলো সেদিনই পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়াওয়ালির কারাগারের মধ্যে শেখ মুজিবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি গোয়েন্দা পুলিশের ক’জন কর্মকর্তার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। বিচারাধীন অবস্থায় শেখ মুজিবের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে বিদেশি সরকারগুলো সে সময় জানার চেষ্টা করে।
মার্কিন সরকারের গোপন দলিল যেগুলো পরে ডিক্লাসিফাই করা হয়েছে সেখান থেকেও কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। দেখা যায়, মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কিন কূটনীতিকরা শেখ মুজিবের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন।কিন্তু তাদের আগ্রহ এমনিতে তৈরি হয়নি। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাস এনিয়ে তৎপর হতে শুরু করে। যেমন, ২২শে মে ইসলামাবাদে আমেরিকান দূত ‘জো ফারল্যান্ড’ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাতের সময় শেখ মুজিব সম্পর্কে জানতে চান।

এরপর তিনি ওয়াশিংটনে যে বার্তা পাঠান তাতে তিনি লিখছেন, “মে মাসে থেকে তার সাথে আমার যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে, তার সবগুলিতে আমি মুজিবের বিষয়ে প্রশ্ন করেছি। আমাকে বলা হয়েছে মামলা পরিচালনার জন্য মুজিবকে একজন দক্ষ আইনজীবী দেয়া হয়েছে। এবং আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে শেখ মুজিবের প্রাণদণ্ড হবে না”। ‘রাজা আনার খান’ পাকিস্তান গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। শেখ মুজিবের ওপর নজরদারির জন্য তাকে কারাগারের একই সেলে রাখা হয়েছিল।
অগাস্টের ২০ তারিখ টেলিগ্রাম থেকে জানা যাচ্ছে, অ্যাম্বাসেডর ফারল্যান্ড বেশ সতর্কতার সাথে ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের গোপন বিচার নিয়ে প্রশ্ন করছেন। “আমি ইয়াহিয়াকে বললাম বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই মামলার দিকে আগ্রহভরে নজর রাখছে। এবং এর সম্ভাব্য রায় সম্পর্কে উদ্বিগ্ন……..ইয়াহিয়া আমাকে জানালেন, রায় যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে শেখ মুজিবের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমাভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে এবং তিনি সেটা গ্রহণ করবেন”। এরপর ইয়াহিয়া বললেন, কিন্তু তিনি সেই আবেদনের ব্যাপারে তখনই কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে ‘কয়েক মাস অপেক্ষা করবেন’ যাতে এই সিদ্ধান্তটা পরবর্তী বেসামরিক সরকারকে নিতে হয়” ।
এরপর ৩০শে সেপ্টেম্বরের টেলিগ্রামে জানানো হয়, মার্কিন কংগ্রেসম্যান ফ্রেলিংঘুসেন ইসলামাবাদে এক সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলছেন, “যে রাজনৈতিক দলটি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তার বিচার কেন গোপনে করতে হবে, তা মার্কিন কংগ্রেস বুঝতে পারছে না”। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এর জবাবে জানান, “শেখ মুজিব দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাদের হাতে আছে। যথাসময়ে সেই বিচারের বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। এখন বিচারের তথ্য বাইরে এলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে”৷
পাকিস্তানে নির্জন কারাবাসের মধ্যে শেখ মুজিবকে কয়েকবার এক জেল থেকে অন্য জেলে সরিয়ে নেয়া হয়। মিয়াওয়ালি, ফয়সালাবাদ, সাহিওয়াল ছাড়াও রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে উত্তর পাঞ্জাবের বস্ত্রশিল্পের শহর লায়ালপুর। সেখানে এক নবনির্মিত একতলা জেলখানায় কঠোর গোপনীয়তা মধ্যে জেলখানায় রেখে তার বিচারের কাজ শুরু হয়৷

এক সাক্ষাৎকারে ‘রাজা আনার খান’ জানান, “তিনি ১৯৭১ সালে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন সাব ইনস্পেকটর ছিলেন। তাকে কয়েদি হিসেবে সাজিয়ে মিয়াওয়ালি জেলে শেখ মুজিবের কাছে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য তার ওপর নজরদারি চালানো।প্রথম কয়েক মাস শেখ মুজিব তার সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলতে চাননি। পুলিশের টিকটিকি হিসেবে তাকে ঠিকই সন্দেহ করছিলেন। পরে দুজনের মধ্যে এক ধরনের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে”।

‘রাজা আনার খান’আরো জানান, “আটক বন্দি হিসেবে শেখ মুজিবকে কারও সাথে কোন কথা বলতে দেয়া হতো না। কোন খবর পৌঁছনো হতো না তার কাছে। তার গ্রেফতারের পর থেকেই যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেটাও তাকে জানতে দেয়া হয়নি।এমনকি বিচারে আসামী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত পাকিস্তানের খ্যাতনামা উকিল এ. কে. ব্রোহিরও কোন অনুমতি ছিল না মামলার বিষয়বস্তুর বাইরে অন্য কোন বিষয় নিয়ে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে। এরা দু’জন যখন কথা বলতো আমি একটি দূরে চেয়ার পেতে বসে থাকতাম ৷ জেলের সেলে কথাবার্তা রেকর্ড করার জন্য একটি চেয়ারের হাতলে রেডিও ট্রান্সমিটারও বসানো হয়েছিল”।
৩রা ডিসেম্বর’১৯৭১ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় শেখ মুজিবকে ফয়সালাবাদ জেল থেকে মিয়াওয়ালি জেলে নেয়া হয়। সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে আনার খান জানান, “যে গাড়িতে চড়িয়ে শেখ মুজিবকে মিয়াওয়ালি নেয়া হয়েছিল সেটির ভেতর লেপ-তোষক দিয়ে এমনভাবে ঢোকা দেয়া হয়েছিল যে তিনি যেন বাইরের দৃশ্য দেখতে না পারেন। আর তাকেও যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়। এমনকি গাড়ির কাঁচও কাদা দিয়ে লেপে দেয়া হয়েছিল”।

শেখ মুজিব যখন জানতে চাইলেন কেন এই ব্যবস্থা তখন আনার খান তাকে জানিয়েছিলেন যে , “কাছেপিঠে সেনাবাহিনীর মহড়া চলছে। তাই সব গাড়ির কাঁচ ক্যামোফ্লাজ করতে হয়েছে”। শেখ মুজিব তার কথা বিশ্বাস করেছিলেন কিনা তা জানা যায়না। এছাড়াও গোলাগুলির শব্দ হলে শেখ মুজিবকে নানা ধরনের বানানো গল্প শোনানো হতো। যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমান হামলা শুরু হলে আমরা নিজেদের এবং এই বিশেষ বন্দির নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করলাম। জেলে তার সেলের বাইরে মাটিতে ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের মতো একটি ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। শেখ মুজিব ভেবেছিলেন তার জন্যই কবর খোঁড়া হয়েছিল। পরে তিনি সাংবাদিক (ডেভিড) ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সে কথা উল্লেখও করেছিলেন। তবে সেটা ভাবাই তার জন্য স্বাভাবিক ছিল। তিনি তো জানতেন না যে বাইরে একটা প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল।”
‘সহ-বন্দি’ হিসেবে ‘রাজা আনার খান’ রাতে ঘুমাতেন শেখ মুজিবের সেলের ঠিক বাইরে আরেকটি সেলে।লন্ডনে কারামুক্ত হয়ে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। ষোলই ডিসেম্বরের রাত। পাকিস্তানী বাহিনী মাত্রই ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে শোক আর পূর্ব পাকিস্তানে আনন্দের স্রোতধারা বয়ে চলছে ৷রাতে দরোজায় প্রচণ্ড খটখট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ‘রাজা আনার খান’বলেছেন, ‘আমি জানতে চাইলাম কে? জবাব এলো আমি খাজা তুফায়েল। জলদি দরোজা খোল’। আমি বললাম, ‘খুলতে পারবো না। নিরাপত্তার ব্যাপার’। তিনি জানতেন তার বন্দীর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
‘খাজা তুফায়েল’ ছিলেন মিয়াওয়ালি কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বললেন, “খুদাকে লিয়ে দরওয়াজা খোল। তোমার আর শেখ মুজিবের জীবন সংকটে ৷রাজা আনার খান বলেন, ‘আমি দরোজা খুলে দিলে তিনি দ্বিতীয় চাবি দিয়ে শেখ সাহেবের সেলের লক খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তাকে ঘুম থেকে জাগাতেই তিনি কিছুটা বিচলিত হলেন ৷খাজা সাহেব তাকে তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নিতে বললে তিনি জিজ্ঞেস করলেন তাকে কি ফাঁসি দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? সেই সময়টাতে কারাগারে মধ্যরাতের পর কয়েদিদের ফাঁসি দেয়ার নিয়ম ছিল। তাই শেখ সাহেব ভেবেছিলেন সেজন্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেজন্যে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন তাকে কী ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু খাজা সাহেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ফাঁসি না, অন্য একটি কারণে তাকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে”।

এরপর আনার খানের সহায়তায় ঐ কারা কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে একটি গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত কারাগারের বাইরে নিয়ে যান এবং শহরের অন্যদিকে আরেকটি বাড়িতে নিয়ে ওঠান। মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্রটির কথা পরে শেখ মুজিব নিজেও স্বীকার করেছেন সিডনি শনবার্গের কাছে।

মিয়াওয়ালি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ‘জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি’ র জেলা। মিয়াওয়ালি কারাগারের বেশিরভাগ কর্মকর্তা আর বন্দি ঐ জেলার লোক। তাই জেলের কিছু কর্মকর্তা কৌশলে শেখ মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তারা ১৫ই ডিসেম্বর কয়েদিদের মধ্যে প্রচার করে যে পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইয়ে জেনারেল নিয়াজি নিহত হয়েছে, আর যার জন্য এসব ঘটেছে সেই শেখ মুজিব ঐ মিয়াওয়ালির ক্যাম্পেই আটক রয়েছেন।তাই কয়েদিদের বলা হলো জেলের তালা খুলে দেয়া হলে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারবে। কিন্তু ষড়যন্ত্রটি ফাঁস হয়ে যায়।অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের জাতির জনক ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে সে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন জুলফিকার আলী ভুট্টো।ঐ সেফ হাউজে কিছুদিন থাকার পর শেখ মুজিবকে সরিয়ে নেয়া হয় রাওয়ালপিন্ডির অদূরে সিহালা রেস্ট হাউজে।সেখানে শেখ মুজিব ও ভূট্টোর মধ্যে একাধিক সাক্ষাতের কথা জানিয়েছেন রাজা আনার খান। ঐ দুই নেতা যখন কথাবার্তা বলছিলেন তখন তিনি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে সব কথা শোনেন।ভুট্টো যখন শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন তখন অন্য সবার সাথে আনার খানও গিয়েছিলেন পিণ্ডির বিমানবন্দরে বাংলাদেশের নেতাকে বিদায় জানাতে।

পাকিস্তান ত্যাগের আগে শেখ মুজিব ‘ফিয়োদর দস্তয়ভস্কি’র উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর একটি কপিতে সই করে ‘রাজা আনার খান’কে উপহার দিয়েছিলেন।
সেখানে লেখা ছিল: “In the long war between the falsehood and the truth, falsehood wins the first battle and truth the last.” (সত্য ও অসত্যের মধ্যে দীর্ঘ লড়াইয়ে প্রথম জয়লাভ করে মিথ্যে, আর শেষের জয় সত্যের।)
পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ১৩ মাস পর ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ আবার সসম্মানে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন । কিন্তু এবার আর রাজবন্দী নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। (চলবে)৷

তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷

ফারহানা আকতার
লেখক: ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র গবেষনা ইনষ্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক ৷

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৪৭:৪৬ ● ২১২২ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ