সরল গল্পের আবেগী পরিণতি

Home Page » শিক্ষাঙ্গন » সরল গল্পের আবেগী পরিণতি
সোমবার ● ৭ মার্চ ২০২২


 চাঁপাডাঙার বৌ

বঙ্গনিউজঃ তারাদাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, চাঁপাডাঙার বৌ।

সাজানো-গোছানো সামাজিক উপন্যাস বলতে যা বোঝায়, ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ পড়ে তা-ই মনে হয়েছে আমার কাছে। একটা গ্রামের দুটো পরিবারের মধ্যেই কাহিনি সীমাবদ্ধ রেখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। চাপাডাঙা অথবা অন্য কোনো স্থানের কাহিনি সম্পূরক হিসেবে যোগ না করে এককভাবে সরল বর্ণনার ঢঙে মিলনাত্মক পরিসমাপ্তি টেনেছেন। এ উপন্যাস অবলম্বনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবদ্দশায়ই ১৯৫৩ সালে সিনেমা বানিয়েছিলেন নির্মল দে। সে কারণেই কিনা, জানি না, লেখাটা চালচ্চিত্রিক পরিচর্যায় নির্মিত। পরে বাংলাদেশেও নায়করাজ রাজ্জাকের নির্মাণে আমরা ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ পেয়েছিলাম ১৯৮৬ সালে।

‘চাঁপাডাঙার বৌ’ সংসারে ভাঙনের সুর ধরাতে ধরাতে এগিয়ে শেষমেশ মিলনের বীণা বাজায়। ভাঙনের কলকাঠি নাড়া দুটো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ঘোঁতন ঘোষ আর টিকুরীর খুড়ী। সহজাত খলবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল উভয়েই। মানুষের প্রত্যেকটা আচরণেরই পেছনে একটা সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। ঘটনাক্রমে ঘোঁতন আর টিকুরীর খুড়ীর খল আচরণের পেছনে পঞ্চায়েতের বিচার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এ ব্যাপারটি কথিত ‘ভিলেজ পলিটিক্স’-এর নোংরা নিদর্শন হিসেবে উপন্যাসে এসেছে।

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ধারণাটা একইভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিপিনের সংসার’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন। বিপিনের বোন বীণার কথা মনে পড়ে প্রতিতুলনায়। জহির রায়হানের লেখা ‘হাজার বছর ধরে’। হালিমা সালেহার মুহূর্তের খল আচরণে আত্মাহুতি দিতে যায়। কিন্তু জীবনের তৃষ্ণার কাছে পরাজিত হয় সে চেষ্টা।

চাঁপাডাঙার বৌয়ের মহাতাপের সাথে বাৎসল্যের বন্ধন। এ ব্যাপারটির কুৎসিত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ভোগায় তাকে টিকুরীর খুড়ী। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে হীরণের বিয়ের আসরে মন্তু আর টুনিকে ঘিরে সালেহা এবং ফকিরের মা প্রশ্ন তোলে। যদিও সে লেখায় মন্তু এবং টুনি উভয়েই এ ধরণের সম্পর্কের ব্যাপারে অল্প হলেও আগ্রহী ছিল। ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ উপন্যাসে এরকম আগ্রহের স্থান নেই। বরং সন্তান-বাৎসল্যই এতে প্রধান হয়ে উঠেছে।

এদিকে সন্তান না হবার ব্যাপারটি নিয়ে টিকুরীর খুড়ী ব্যক্তি-আক্রমণ করলে আত্মঘাতী হতে দেখি বড় বৌকে। সেতাবের পথভ্রষ্টতা ত ছিলই।

‘চাঁপাডাঙার বৌ’ উপন্যাসে রাধাকৃষ্ণের প্রেমসংগীত এসেছে মানদার গানে -

“… খুলতে গেলাম বাজুবন্ধ বাঁধন যে সেই খুলল না!
ভুলতে গেলাম তারে সখি ভুল যে মোকে ভুলল না।
কালনাগে ধরতে গেলাম—
কালীয়ারে জড়াইলাম—
মরতে গিয়ে অমর হলাম জ্বলতে জ্বলন জ্বালাতে?…”

মহাতাপ-মানদার সংসারে প্রেমের অল্প কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব দেখা যায়।

- হ্যাঁ। আমার কোলে মাথা রেখে শো। আমি জল দেখি আর তোকে দেখি। হঠাৎ এই বর্ষার আমেজে তাহার আবেগ-উথলিয়া উঠিল। সে দুইহাতে মানুর মুখখানি ধরিয়া বলিল, পাগলি পাগলি পাগলি! তোকে আমি খু-ব ভালবাসি।
- ছাই বাস। দিনরাত-মারব, মারব আর আকথা কুকথা!
- আরে। সে কথা তোকে না মানু তোকে না। তোর ক্যাঁট-কেঁটে কথাকে-
- হুঁ। বড় মোল্যানের কথাগুলা তো মিষ্টি লাগে! তার বেলা?
আরে বাপরে! দুই হাত জোড়া করিয়া কপালে ঠেকাইয়া মহাতাপ বলিল, আরে বাপরে, বড়কী বহু, উ তো ঘরকে লছমী হ্যায়।
মহাতাপ মানদাকে সজোরে বুকে চাপিয়া যেন পিষিয়া ফেলিল।

তারাশঙ্কর ‘কবি’ আর ‘সপ্তপদী’তে যে প্রেম লিখেছেন, ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ সে ধারায় ব্যতিক্রম। এখানে পুরোদস্তুর দাম্পত্য প্রেম। সমাজের চোখে যাতে কোনো কলঙ্ক হবার নয়।

কৃষ্ণস্বামী ত জাতই দিয়ে দিল প্রেমের জন্য।

সেদিক দিয়ে ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ প্রেমের বেলায় কিছু বৈচিত্র্যহীন। দুঃসাহসিক কিছু করে ফেলবার প্রেষণা তারাশঙ্কর মহাতাপকে দেননি।

অবশ্য প্রেম করতে গিয়ে স্থির হয়ে থাকা বিয়ে ভেস্তে দিয়েছে ঘোঁতন ঘোষ। কাহিনির গঠনবিচারে তার সেরকম সর্বগ্রাসী প্রভাব না থাকায় এ প্রেমের ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ তেমন নেই।

‘চাঁপাডাঙার বৌ’ পড়তে নিয়ে শুরু থেকেই একে একটা সোজাসাপ্টা ফ্যামিলি ড্রামা ধরণের উপন্যাস মনে হয়েছে।
সে কারণে এ উপন্যাস নিয়ে বিস্তারিত লেখার চিন্তা প্রথমত করিনি। পরে যত সামনে এগিয়েছে পড়া, সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক কিছু উপাদান আমাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।

সই মা, বড় বৌ আর মানদার চরিত্রের মাতৃরূপের আলাদা আলাদা বিশেষত্ব চাইলে খুঁজে বের করা সম্ভব।

সই মা সেতাবের সংসারের অমঙ্গল বুঝে তা ঠেকানোর প্রতিজ্ঞা থেকে সেতাবের দেওয়া পোশাক ফিরিয়ে দেন। তাতে মাতৃবিশেষত্ব উজ্জ্বল হয়। উজ্জ্বল হয় তার শক্ত ব্যক্তিত্ববোধ।

বড় বৌ যদিও তাবিজ ধারণ করে সন্তানের আশায়, তবু তার চিরায়ত মাতৃত্ব তাকে সেসব ছিঁড়ে জলে ফেলতে উদ্যত করে তোলে।

আবার মহাতাপ মানিককে দিয়ে দিচ্ছে বড় বৌকে। এ অবস্থায় মানদার প্রতিক্রিয়া……

আরেকটি জরুরি বিষয় না লেখাটা অন্যায়ের পর্যায়েই পড়বে। যেদিন বড় বৌ চাপাডাঙা চলে যাবেন তার আগের রাতে সেতাবের মনের খচখচানিটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাটায় তার ভুল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। দেখা যেতে পারে ।

সংকলনেঃ মাসুম আজাদ

বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৭:৪৫ ● ৩৭৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ