পুতুল নাচের ইতিকথা
Home Page » ফিচার » পুতুল নাচের ইতিকথামানুষের জীবনটা একটা রঙ্গমঞ্চ। সেই মঞ্চে পুতুলনাচের পাত্র হয় মানুষ। কিন্তু কে নাচায়? মানুষ কি জানে, তাকে পুতুলের মতো করে নাচাচ্ছে অন্য কেউ? জানলেও কি সে বাঁধন ছিঁড়তে চায়? নাকি জীবনপথের রঙ্গমঞ্চে পুতুলনাচের পুতুল হয়েই কাটিয়ে দিতে হয় তাকে? মানবজীবনরূপী এই রঙ্গমঞ্চের পুতুলনাচ খেলার গল্প বলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার পুতুলনাচের ইতিকথায়।
পুতুল নাচের ইতিকথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস । উপন্যাসটি ভারতবর্ষ পত্রিকায় বাংলা ১৩৪১ সালের পৌষ থেকে ১৩৪২ সালের অগ্রহায়ণ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।
এক মর্মান্তিক বাজ পড়ার মধ্য দিয়ে গল্পের শুরু। উপন্যাসের পটভূমি গাওদিয়া গ্রাম। গ্রামের প্রায় সকল মানুষই অশিক্ষিত ও মূর্খ। গল্পের প্রধান চরিত্র শশী ডাক্তার । তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সাধারণ ও জটিল সব সম্পর্ক । গাঁয়ের ছেলে হলেও শহরে লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছে সে। ছোটবেলায় পড়া “মাই এইম ইন লাইফ” এর মতই পড়ালেখা শেষ করে নিজ গাঁয়ে ফিরে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয় সে । কখনো বা নিজের প্রয়োজনে অথবা কখনো সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে তাকে মাঝে মধ্যেই শহরে যেতে হয় । এমনই এক দিনে শহর থেকে ফেরার পথে নদীর ধারে এক বটগাছের নিচে হারু ঘোষ এর মৃতদেহ উদ্ধার করে সে । এই হলো উপন্যাসের শুরু।
এই হারু ঘোষ এর মেয়ে মতি ও তার পুত্রবধু কুসুমের সাথে সর্ষের এক জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান। শশীর মনন দ্বিমুখী। সে কী চায়, সে নিজেও জানে না। সে কখনো চায় নিজের গাঁয়ের ভালোবাসায় আমৃত্যু বেঁচে থাকতে। আবার কখনো ভাবে, কী হবে এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে থেকে? তখন তার কল্পনার দৃষ্টি তাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে, অন্য কোনো উন্নত দুনিয়ায়। শহরের চাকচিক্যময় জীবনের স্বপ্নও দেখে সে।
ইগো, সুপার-ইগোর এই দ্বন্দ্বে পড়ে দিশাহারা অবস্থা হলেও শশীর মূল কিন্তু এই গাঁয়েই বাঁধা! সে মূল উৎপাটন করবে কে? বরঞ্চ কুসুম, মতির মতো চরিত্ররা সেই মূল আরও গভীরে প্রোথিত করে। এদের কাউকে আশ্রয় করে সে বাঁচতে চায়। কাকে? হয়তো মতিকে।
কিন্তু হঠাৎ করেই শশীর কলেজজীবনের বন্ধু কুমুদ যখন মতিকে ‘দখল’ করে নেয়, বিয়ে করে দূরে কোথাও চলে যায়, তখন শশীর একটি আশ্রয় ছিন্ন হয়ে যায়। মতিকে পাওয়ার জন্য সে এতটাই উতলা হয়েছিল যে সে ভাবে, নিজেই মতিকে বিয়ে করবে। এ কথা যখন সে কুসুমকে জানায়, কুসুম তা হেসে উড়িয়ে দেয়। কুসুম এক রহস্যময় মানবী। তার কাছে শশী পরোক্ষভাবে পরাজিত হয় সবসময়। মতিকে হারানোর ভয় কি কিছুটা প্রশমিত হয় কুসুমের মাঝে? কুসুম কী চায়, শশী তা বুঝতে পারে না। আর শশী নিজেও জানে না, কুসুমকে সে ভালোবাসে কিনা। তাদের এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব খোলাসা হয়, যখন কুসুম গাঁ ছেড়ে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে। তখনই শশীর চোখের সামনে থেকে সব অন্ধকার ঘুচে যায়। সে টের পায়, কুসুমই তার শেষ আশ্রয়স্থল।
মরিয়া হয়ে সে কুসুমকে বলে ফেলে তার মনের কথা। নির্লজ্জের মতো পালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু কুসুম জানায়, সাত বছরে এটুকু আহ্বানই সে চেয়েছিল, কিন্তু তা সে পায়নি। কোনো একসময় শশীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে‘এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু’ বলা কুসুম এবার তাকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করে, কারণ দীর্ঘ সাত বছরে কুসুমের ভালোবাসার ফুল শশীর অনাদরে, অবহেলায় তাদের দুজনের অজান্তেই ঝরে গেছে- এখন আর সেই অব্যক্ত ভালোবাসাকে পুনর্বার উজ্জীবিত করার কোনো উপায় নেই। শশীর জন্য কুসুমের মনে আর ছিটেফোঁটা ভালোবাসাও নেই। এ জায়গায় এসে পাঠকের মনে হবেই, ভালোবাসার কী নিদারুণ অপচয়। শুধু মনোগত যোগাযোগের অভাব বলে আজ এই অকৃত্রিম, অ-স্বীকৃত ভালোবাসাটুকু প্রস্ফুটিত হতে পারল না।
তারপর কী হয় শশীর? কুসুমও নেই, মতিও নেই– তারাই তো এতদিন তার আত্মাকে এ গ্রামে বেঁধে রেখেছিল। নিজের বাপ গোপালকে কখনো মন থেকে ভালোবাসতে পারেনি শশী। মতি আর কুসুমের প্রস্থানে এই গাওদিয়ায় তার জন্য আর কেউ রইলো না। তবে কি শশী নিজের স্বপ্নের দুনিয়ায় চলে যাবে? যেখানে কোনো পিছুটান নেই, নেই মায়ার ভ্রান্তি। কিন্তু মৃত্যুর আগে যাদব যে তাকে নতুন দায়িত্ব দিয়ে যায়। গাঁয়ে হাসপাতাল বানানোর কাজ, সেই হাসপাতালের ভার গ্রহণের কাজ। চিরকাল গ্রামের বদ্ধ জীবন থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে চাওয়া শশীকে অবশেষে সেই আরেক নতুন বন্ধনের ফাঁদে পড়ে যেতে হয়। যে ফাঁদ থেকে বের হওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না তার হাতে। গ্রামের হাসপাতালের স্থায়ী ডাক্তার হিসেবে শশীর নতুন জীবন শুরু হয়।
এও যেন এক পরিহাস! শেষ পর্যন্ত যাদবই যেন শশীর জীবনে পুতুলনাচের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হয়। জীবনরূপী এই পুতুলনাচকে বরণ করে নিতে হয় শশীকে। পুতুলের সুতো ছেঁড়া আর তার হয় না। উপন্যাসটির শেষে শশীর আপাত এই পরিণতি দেখে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে নিজের জীবন নিয়েও- জগৎসংসারে আমরা সবাই যে এক পুতুলনাচের চক্করে বাঁধা পড়েছি। এ থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই?
আমার দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসটি গ্রাম বাংলার পটভূমিকে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করতে সার্থক । সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপীত উপন্যাসটি জেনো নিত্য ঘটে চলা গ্রামবাংলার চলমান ঘটনাগুলো দ্বারা প্রতীয়মান।
উপন্যাসের নামকরণ সম্পর্কে ঔপন্যাসিক নিজেই বলেন “সত্যই তো আর পুতুল নয় মানুষ। অদৃশ্য শক্তি বা অন্য অন্য মানুষের আঙ্গুলে বাঁধা সুতোর টানে সত্যই তো মানুষ পুতুলের মত নাচে না।”
কিন্তু তিনি যখন পুতুল নাচের ইতিকথা নামে উপন্যাস লিখলেন প্রশ্ন আসতেই পারে এই পুতুলের অদৃশ্য দড়ি কার হাতে? এর উত্তর পেতে হলে পাঠকদের উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র শশী এবং আবর্তনে থাকা গাওদিয়ার মানুষের জীবন সাদামাটা জীবন যাত্রার গভীরতাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাহলে পাঠক বুঝতে পারবেন, লেখকের মতে সেই অদৃশ্য দড়ি কোন অদৃশ্য শক্তির কাছে বাঁধা পরে নেই। বাঁধা পরে আছে মানুষের নিজের হাতেই। মানুষ সব জেনেও পুতুল হয়ে থাকে, কখনো সমাজের কাছে, কখনো পরিবারের কাছে, কখনো ভালোবাসার মানুষের কাছে। যেমন কুসুম সাতটি বছর অবহেলার পুতুল হয়ে কাটিয়েছে গাওদিয়ায়। আবার নিজে থেকে সুতো টেনে গুটিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি। এমন অনেক দৃষ্টান্ত লেখক মানুষের জীবন নামের পুতুল খেলাকে পাঠকের সামনে স্পষ্ট করেছেন।
উপন্যাস: পুতুল নাচের ইতিকথা
লেখক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
সংকলনে: মাসুম আজাদ
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩৫:৩৭ ● ১২০৫ বার পঠিত
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)-
আইএমএফ অগ্রাধিকার দেবে চার বিষয়ে
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪ -
যেভাবে নিরাপদ সবুজ কারখানার দেশ হয়ে উঠল
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪ -
শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা সুশাসনের অভাবে
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪ -
বিনা ভোটে জয়ের পথে এমপিপুত্রসহ ২৫ প্রার্থী
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪ -
আশুলিয়ায় সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তার জমি দখলের চেষ্টা, থানায় মামলা
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
জবিতে এক সপ্তাহ অনলাইনে ক্লাস তীব্র তাপদাহে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
পদত্যাগ করলেন মহিলা দলের নেত্রী উপজেলা নির্বাচন করতে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
অভিনেতা অলিউল হক রুমি আর নেই
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
কুলিং ব্রেক সুপার লিগে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
আজ ফের ভোট মণিপুরের ১১ কেন্দ্রে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪
-
বিনা ভোটে জয়ের পথে এমপিপুত্রসহ ২৫ প্রার্থী
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪ -
শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা সুশাসনের অভাবে
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪ -
যেভাবে নিরাপদ সবুজ কারখানার দেশ হয়ে উঠল
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪ -
আইএমএফ অগ্রাধিকার দেবে চার বিষয়ে
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]