সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৫: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৫: স্বপন চক্রবর্তী
শনিবার ● ২১ মে ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ:  ( গত নভেম্বর’২১ এর শেষ সপ্তাহে হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া সীমান্তে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার উপর কিছু লিখার জন্য অনুরোধও ছিল। তাই বসে বসে সময় ক্ষেপন করেছি মাত্র। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হেতু সন্নিবেশিত ভুল তথ্য শুধরে দিলে উপকৃত হবো )।

ছিটমহল থেকে হাটতে হাটতে বাংলাদেশ ভুখন্ডের শেষ প্রান্তে চলে গেলাম। আর এক কদমও আগে বাড়ানোর উপায় নেই। সাথে আমার ছেলে স্বনন, আমার মিত্র গজেন বাবুর ছেলে শংকর এবং স্থানীয় আরও দুজন যুবক একত্রে শীর্ণকায়া খরস্রোতা ”খর্প” নদীর পারে এসে দাঁড়ালাম। এই নদীটি দুটি দেশের সীমানা নির্দেশ করছে। কিন্তু খুবই অপ্রশস্থ। মাত্র চার পাঁচ গজ হবে। যদিও অনতি দূরে সীমানা পিলার দন্ডায়মান আছে। দেখলাম নদী থেকে নির্ভয়ে একটি দাঁড়াস সাপ কিনারে ভারতের অংশে উঠে গেল। এতো বড় দাঁড়াস সাপ ইতিপূর্বে আমি দেখিনি। ওদের কাছে সীমানা পিলার বলে কোন বাছ বিচার নেই। হঠাৎ সামনের বাঁশঝাড় থেকে বেড়িয়ে এলো ভারতের একজন বিএসএফ ( Border security force ) সদস্য। অপ্রশস্থ নদীর দুপারে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ কথা হলো। আমরা জানতে চাইলাম অনেক কিছু। তিনিও জিজ্ঞেস করছিলেন আমাদের অনেক কথা। বিএসএফ সদস্যের কথায় কিছু আক্ষেপ ছিল আমাদের বিজিবি ( Border Guard Bangladesh) সদস্যগণের সম্পর্কে। বিজিবি সদস্যগণের অনেকেই কোন আন্তর্জাতিক ভাষা ব্যবহার করতে নাকি সক্ষম নয়। তারা ইংরেজি বা হিন্দী বলতে পারে না। ফলে সীমান্তে উদ্ভুত ছোটখাটো কোন সমস্যার ক্ষেত্রে আলোচনা করে সমাধান সম্ভব হয় না। ফ্ল্যাগ মিটিং করে কোন সমাধান করাও কঠিন হয়। তার মতে অন্তত বিজিবি সদস্যদেরকে ওরিয়েন্টেশন কোর্স বা অন্য কোন ভাবে ভাষা জানার কোন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যেহেতু তারা ডিউটি করে আন্তর্জাতিক সীমানায়। আমি তো জানি আমাদের দৌড়। প্রায় প্রতিষ্ঠানের মধ্যম ধরনের কর্মকর্তা হলেও ভিন্ন ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারদর্শী নয়। কারণ আমরা সেই জাতি , যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দান করেছি। অন্য ভাষা শিখবো কোন দুঃখে।

ছবি- খর্প নদী, ওপারে বাঁশ ঝাড়টি ভারতের কুচবিহার জেলার শীতলখুচির একটি গ্রাম
এক প্রশ্নের উত্তরে বিএসএফ সদস্য জানান যে, কিছু অসাধু ব্যক্তির লোভের কাবণে সীমান্তে গরু চুরি সহ চোরা চালান হয়ে আসছে। বন্ধ করা যাচ্ছে না। বড় ধরনের প্লাস বা সাঁড়াশি দিয়ে কাঁটা তারের বেড়া কেটে ফেলে। কাঁটা তারের বেড়ার উপর দিয়ে কপিকলের মতো করে গরু এক পাশ থেকে তুলে অন্য পাশে পাচার হয় । দেখলে মনে হবে যেন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে জাহাজ থেকে মাল খালাসের কাজ চলছে। কুয়াশার কারণে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে দুরে দেখা যায় না বলেও জানান। দেশের অভ্যন্তরের এক ব্যক্তি খুব বড় সাঁড়াশী সহ সীমান্তে ধরা পড়ার সংবাদ কিছুদিন আগেই সম্প্রচারিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। গরু পাচারের আধুনিক পদ্ধতিও প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে দেখেছি। নদীতে ভাসিয়ে দেয় গরু। আর সেই গরুকে সাঁতড়িয়ে অনেক দুরে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। পরে বহু দুরে গিয়ে তাদেরকে ধরা হয়। প্রচন্ড শীতে নদীতে অন্তত ১৫ টি গরুর সলিল সমাধি হবার খবরও প্রচারিত হয়েছে। ট্রাক বোঝাই করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার দিকে। শুধু কি তাই ? এই গরু গুলোকে ট্রাকে তুলার আগে চোখে শুকনো মরিচের গুঁড়ো মালিশ করে দেওয়া হয়। গরুচোর বিশেষজ্ঞ গণ জানেন যে, গাদাগাদি করে ট্রাকে ওঠানো গরু গুলো দীর্ঘ রাস্তা পারি দিতে গিয়ে কখনো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তাই এই ব্যবস্থা। বাজারে নিয়ে গেলেও গ্রাহকগণ পরখ করা কালে গরুগুলোকে যাতে করে সতেজ দেখাতে পারে তাই লেজে সাঁড়াশী দিয়ে চাপ দিয়ে লেজটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। গ্রাহক লেজে হাত দিলে গরুটি তখন লাফিয়ে উঠে। প্রচলিত আইনে পশু নির্যাতন নিষেধ থাকলেও এ সব সংবাদ প্রচারিত হয়।
ফিরে আসতে আসতে মাথায় একটা প্রশ্ন দেখা দিল। এই যে সীমান্ত, কোথাও কোথাও এর কোন নদী নেই, শুধু ক্ষেতের একটি আইল মাত্র সীমানা নির্দেশ করছে। গরু-ছাগল হাঁস-মুরগী এরা কোন আইনের ধার ধারে না। তারা উভয় পাড়েই সমানে বিচরণ করে। সীমানা অতিক্রম করে। এমন মুহূর্তে কিছু অসাধু লোক একটা ছাগল নিয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে ভীষণ উত্তেজনা। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলো। পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রয়োজন হলো ফ্ল্যাগ মিটিং এর। প্রয়োজন সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়া । কারণ সংলাপই পারে সকল উত্তেজনা প্রশমণ করতে। কথার কারণেই অনেক সময় মিত্রও শত্রু হয় আবার শত্রুও মিত্র হয়। যুদ্ধ লেগে যেতে পারে কথার কারণে আবার যুদ্ধ থেমে গিয়ে শান্তি স্থাপনও হতে পারে আলোচনায়।
এহেন অবস্থায় আমাদের সীমান্ত রক্ষীগণ ভাষার কারণে যদি তাদের সাথে কোন আলোচনা করতে ব্যর্থ হন তবে পরিস্থিতি শান্ত হওয়া কঠিন। সময় ক্ষেপণের ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাই স্বাভাবিক। ভারতের সীমান্ত রক্ষীগণ সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সীমান্তে তাদের ডিউটি করতে হয় এবং বিভিন্ন রাজ্য থেকে তারা নিয়োজিত হয়। তারা অধিকাংশই হয় অবাঙ্গালী। আর বাংগালী হলেও তারা সাধারণত ইংরেজী ও হিন্দী ভাষায়ও পারদর্শী হয়। যার সাথে আমাদের কথা হয়েছিল, সেই বিএসএফ সদস্যটি এখানে পোস্টিংয়ের অব্যবহিত পুর্বে পাকিস্তান সীমান্তে ছয় বছর কাজ করে এসেছেন। দুই সীমান্তের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। নিরপেক্ষ ভাবেই মনে হলো কথাগুলো বলেছেন। দুই সীমান্তের চোরাচালানের তুলনা মূলক পার্থক্যও জানালেন।
কোন অনিবার্য কারণে পতাকা বৈঠক হলে তাদের সাথে কথা বলতে বাধ্য হয়ে আমাদের বিজিবি এর উর্ধতন কর্মকর্তাদের ডাকতে হবে। আবার প্রটোকল অনুযায়ী ভারতের বিএসএফ এরও সম পদমর্যাদা সম্পন্ন অথবা দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত একজন কর্মকর্তাকে ডাকতে হবে। সব কিছু মিলে সময় যাবে কয়েকদিন আর খরচের বিল হবে লাখো টাকার অংকে। বিষয় ছিল মাত্র এক হাজার টাকা দামের একটি ছাগল। নাহ্ ! ছোট মাথায় এতা জটিল জিনিষ চিন্তা করা ঠিক নয়। এটি সমাধান করা আমার কাজ নয়। বরং প্রসঙ্গক্রমে একটি গল্প বলি।
এক ভদ্র লোক প্রায় প্রতিদিনই মাটিতে আঁচড় কেটে তার পাওনা-দাওনার বিরাট বিরাট অংক কষতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যাংকারদের মতো তার দুই পার্শ্ব (দুই সাইড) মিলে না। সে লিখে- আমি রহমানের কাছে পাই ৩৮/ টাকা, আনোয়ারের কাছে পাই ৫৪/ টাকা, সাজ্জাদের কাছে পাই ৯৮/ টাকা। এইরুপ ভাবে হিসাবের যোগফল দেখা যায় বড়জোড় ৫০০/ টাকা। তার মানে হলো আশানুরূপ কোন প্রাপ্তির সুযোগ দেখতে পাচ্ছে না। আবার দায় অর্থাৎ তার কাছে কে কত পায় তার হিসাব শুরু করে। প্রথমেই দেখে আফজাল পায় ২৭৬/ টাকা। করিম পায় ২৪৩/ টাকা সুবল পায় ৮৯/ টাকা, রমিজ পায় ৫৬০/টাকা । মোট দাঁড়ায় ১১৬৮/ টাকা। ক্রমান্বয়ে অংকটা যখন বেড়েই চলেছে এবং সেটা হাজারের ঘর দ্রুত অতিক্রম করে চলেছে, তখন সে মাটিতে একটানে সব কেটে দিয়ে বলে যে, ”আরে ধেৎ, কেউ আমার কাছে কিছু পায় না”, কেউ কিচ্ছু পায় না”। সব দায় থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এমনি ভাবেই চলে তার হিসাব-নিকাশ। আমিও সব কাটা দিয়ে জটিল হিসাব থেকে এখন ছুটি নিলাম।
( ছবির বাঁশ বাগানটি ভারতের কুচবিহার জেলার শীতলখুচি থানার একটি গ্রাম। বাঁশ ঝাড়ের পড়েই কাঁটা তারের বেড়া)

চলবে-

বাংলাদেশ সময়: ২০:৪৮:৫০ ● ৯৩৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ