সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ১২; স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ১২; স্বপন চক্রবর্তীবঙ্গ-নিউজ: আগেই বলেছি, গরুর গাড়িই ছিল সেখানকার গ্রামাঞ্চলের চলাচলের একমাত্র যানবাহন। শোনেছি গরুর গাড়ীতে বসে ভাওয়াইয়া গান করতে করতে যখন শিল্পীগণ চলাচল করতো, তখন গাড়ীর চাকা গর্তে ( লিক বা ধারী ) বার বার পড়ে যাওয়ার কারণে নাকি ভাওয়াইয়া গানের সুরেও এক একটি করে ঢেউ বা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হয়ে উঠতো। সুরে একটা ভাঁজ ভাঁজ পড়তো। যেমন, লোকে যেমন ময়নারে পোষে পিঞ্জরায় ভরিয়া. …য়া ..য়া..য়া.. হাহ্ আ –এই রুপ। এই “হ” ধ্বনি সহযোগে গলা ভাঙ্গার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ভাওয়াইয়া গানে। যেমন ওকি মোর কাজল ভোমরারে, কুন দিন আসিবেন বন্ধু কয়য়া যাও রে। এখানে ধ্বনি যেমন, অহ্ কিও হ্ হ্ হ্ বন্ধু মোহ্ রহ্ কাহ্ জোহ্ ল ভোহ্ মোরাহ্ রে হ্ হ্ হ্ , রে কুহ্ ন দিহ্ ন আহ্ সি বেন বন্ধু কয়য়াহ্ যাহ্ ন কয় য়া যাহ্ ন রে। শেষে এই ভাঁজ বা ভাঙ্গাটাই নাকি একটা স্টাইল হিসাবে স্বীকৃত হয়ে যায়। আর এটাই হয় ভাওয়াইয়া গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেই সব বিখ্যাত বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গান যেমন, ওকি গাড়য়াল ভাই.. .কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে। গাড়িয়াল ভাই ,হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারি বন্দর,। বাওকুমটা বাতাস যেমন ঘুইড়া ঘুইড়া মরে, ওরে সেই মতোন মোর গাড়ির চাকা পন্থে পন্থে ঘুরে রে। অথবা বানিয়া বন্ধুরে একখান তাবিজ গড়েয়া দে, মরিয়া গেইছে সোয়ামী ধন মোর নিন্দতে আইসে। ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দে রে। ধীরে চালাও গাড়িরে গাড়োয়ান আস্তে বোলান গাড়ি, আর এক নজর দেইখা লওং মোর দয়ার বাপের বাড়ি রে গাড়োয়ান আস্তে বোলান গাড়ি। অথবা ও মোর দেওরা রে, তোক দেখং মুই নিজের মানুষের মতো। আরো অনেক ভাওয়াইয়া আছে, যেমন যে জন প্রেমের ভাব জানে না,কোন দ্যোশে যান মইষাল বন্ধুরে, পানিয়া মরা মোক মারিলু রে, আরে নওদারিটা মরিয়া মোর সে হইছে হানি ,আধার ঘরত পড়ি থাকুং পড়ে চোখের পানি , থাক থাক থাক দেওরা রে তুই ভাবনা করিস না ,তোর বাদে মুই জুইড়া থোছুং সুন্দরী কইনা। ইত্যাদি।
লোকগীতির অন্যতম ও জনপ্রিয় একটি অমর সৃষ্টি হলো এই ভা্ওয়াইয়া গান। একেবারেই পল্লী জীবনের সাদামাটা সুখ-দুঃখের সরল উপস্থাপন নিয়েই হলো ভাওয়াইয়া। দইখাওয়া বাজারে বিকালে নির্ধারিত সময়ে ( সম্ভবত বিকাল সাড়ে চারটায় ) রংপুর বেতারে তখনকার শিল্পী আব্বাছ উদ্দিন, কছিমুদ্দিন, শরীফা রানী, হরলাল রায়,রথীন্দ্র নাথ রায়, ফেরদৌসি বেগম ও অন্যান্যের কন্ঠে ভাওয়াইয়া শোনার জন্য শ্রোতারা রেডিও ঘিরে বসে থাকতো। আমরাও অপেক্ষা করেছি কতো। বিধুদার ( বিধূভূষণ বর্মন ) চা-মিষ্টির দোকানে ভাওয়াইয়া গান প্রচারের সময়ে তখন ভীড় একটু বেশী হতো। কারণ বিধূদার ছিল একটি ৩ ব্যান্ড ফিলিপস্ রেডিও। সবাই ভাওয়াইয়া শোনতো। বিধূদা এখনো আছেন, দইখাওয়া বাজারে আছে সেই চা-মিষ্টির দোকানও। শুধু ভাওয়াইয়া শোনার সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।
ভাওয়াইয়া গান সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় ভাওয়াইয়া একটি প্রাচীন সংগীত। কথায় বলে বাংগালীর গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গান। সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখার ইতিহাস খুব সুপ্রাচীন। সেই সংগে লোক সঙ্গীতের ইতিহাসও । ভাওয়াইয়া লোক সংগীতেরই একটি অংশ, তাই এটিও সুপ্রাচীন। এই গানের প্রধান উপজীব্যই হলো মাটি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবন গাথা। কোন এলাকার লোক সংগীত জানলে সেই অঞ্চলের জীবনের চিত্র বুঝে নিতে পারা যায় অনায়াসে। উত্তর বঙ্গের কোচ রাজ বংশীয়গণ এই ভাওয়াইয়া গানের স্রষ্টা বলে মনে করা হয়। ভারতের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, জেলার সমভুমি অঞ্চল , পশ্চিম দিনাজপুর জেলার উত্তরাংশ, অসমের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ী জেলা এবং বাংলাদেশের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী , গাইবান্ধা, ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশে এই ভাওয়াইয়া গান প্রচলিত। সুপ্রাচীন এই জনপদের নিজস্ব সৃষ্টিশীল ধারা ভাওয়াইয়া গান। গানে তিস্তা, ধরলা,ও ব্রহ্মপুত্রের কথা এর মধ্যে উঠে এসেছে। এর রয়েছে নিজস্ব ঢং ও রীতি। এই অঞ্চল দিয়ে দিয়ে প্রবাহ হতো তিস্তা, ধরলা , দুধকুমার, কালজানি, ক্ষীরক্ষ্যাপা, তোরষা, খর্প প্রভৃতি নদী। খরস্রোতা এ সব নদীর প্রতিনিয়ত ভাঙ্গনের ফলে জলকাদার সৃষ্টি ও গতি পথের পরিবর্তন হতো। এ সব জলকাদাপূর্ণ তীরে মধুয়া কাশিয়া জন্মাতো। এই সব স্থানকে বলা হতো ”ভাওয়া” অঞ্চল। এই ভাওয়া অঞ্চল থেকে মইষালরা মহিষ চড়াতো এবং গান গাইতো। তাই এই গানকে ভাওয়াইয়া নামে অভিহিত করা হয়। এটিই বহুল প্রচলিত একটি ধারণা। অন্যদিকে সুরসাধক প্রয়াত সুরেন রায় বসুনিয়ার মতে, “ ভাবপূর্ণ “ যে সঙ্গীত মানুষকে ভাব-বিহ্বল করে তাই ভাওয়াইয়া। ভাব-ভাও-+ইয়া= ভাওয়াইয়া। অর্থাৎ ভাবুকের গান। আরও অনেক মত রয়েছে। পরিশেষে সুখ বিলাস বর্মার মতে ভাব থেকে ভাও , পরে ভাবাইয়া ও ভাওয়াইয়া শব্দের উত্তরণ। প্রেম ও বিরহই এর প্রধান উপজীব্য। পল্লীর যুবতী নারীর প্রেমার্তি,মিলন ব্যাকুলতা ও বিচ্ছেদ বেদনা ভাওয়াইয়া গানে যতটা প্রকাশ পায়, অন্য কোন গানে সে রকমটা প্রকাশ পায়না। পি ভি শেলীর মতে- Our Sweetest songs are those that tell of saddest thought. ভাওয়াইয়া গানে খুব সহজেই বিরহ বিচ্ছেদ খুব করুণ ভাবে ফুটিয়ে ওঠে শিল্পীদের কন্ঠে। তাই ভাওয়াইয়া গান এতো মধুর। বাউদিয়া নামে “ উদাসী” সম্প্রদায় এ গানের রূপকার বলেও কেউ কেউ মনে করেন। বাউদিয়া থেকেই ভাওয়াইয়া উৎপত্তি বলে অনেকে ধারণা করেন। চলবে-
বাংলাদেশ সময়: ২০:২২:০৬ ● ৪৮৭ বার পঠিত
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)-
আইএমএফ অগ্রাধিকার দেবে চার বিষয়ে
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪ -
যেভাবে নিরাপদ সবুজ কারখানার দেশ হয়ে উঠল
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪ -
শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা সুশাসনের অভাবে
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪ -
বিনা ভোটে জয়ের পথে এমপিপুত্রসহ ২৫ প্রার্থী
মঙ্গলবার ● ২৩ এপ্রিল ২০২৪ -
আশুলিয়ায় সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তার জমি দখলের চেষ্টা, থানায় মামলা
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
জবিতে এক সপ্তাহ অনলাইনে ক্লাস তীব্র তাপদাহে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
পদত্যাগ করলেন মহিলা দলের নেত্রী উপজেলা নির্বাচন করতে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
অভিনেতা অলিউল হক রুমি আর নেই
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
কুলিং ব্রেক সুপার লিগে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪ -
আজ ফের ভোট মণিপুরের ১১ কেন্দ্রে
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০২৪
-
যেভাবে নিরাপদ সবুজ কারখানার দেশ হয়ে উঠল
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪ -
আইএমএফ অগ্রাধিকার দেবে চার বিষয়ে
বুধবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৪
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]