সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩১; স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ৩১; স্বপন চক্রবর্তী
মঙ্গলবার ● ১২ জুলাই ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ: লেটো গান ও কাজী নজরুল ইসলাম-৩
নজরুলের গানের প্রসঙ্গ যখন আসলো, তখন তাঁর শ্যামা সঙ্গীতের কথা অনুল্লেখ থাকতে পারে না। নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত খুব উৎকৃষ্ট মানের। এই শ্যামা সঙ্গীত নিয়ে একটু লিখতে ইচ্ছে পোষণ করছি।
নজরুলের আগে আরও বহু কবি শ্যামা সঙ্গীত লিখেছিলেন বটে, তবে নজরুল ছিলেন শ্রেষ্ঠ। সাধক রামপ্রসাদ সেন ছাড়াও আকবরের রাজ সভার কবি তানসেন, চট্টগ্রামের বিরিদ খাঁ,মুন্সী বেলায়েত হোসেন, সৈয়দ জাফর খাঁ, হুসেন আলী মির্জা এমন অনেকেই শ্যামা সঙ্গীত লিখে ছিলেন। তবে রামপ্রসাদ সেনের পরেই নজরুল ছিলেন শ্রেষ্ঠ। মুসলিম কবিদের শ্যামা সঙ্গীতের মধ্যে একমাত্র নজরুল ইসলামের শ্যামা সঙ্গীতই কালজয়ী। রাম প্রসাদ সেনের হাত ধরেই প্রথম শুরু হয়েছিল শ্যামা সঙ্গীতের রূপ কথার জগত। আরও ছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, ঈশ্বর গুপ্ত, গিরীশ ঘোষ, নবীন সেন, দাসরথী রায় প্রমূখ। তবে নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতই সব চেয়ে জনপ্রিয় এবং সংখ্যায়ও ছিল সবচেয়ে বেশী। নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত রচনার পর হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কট্টর কট্টর লোকদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে ছিলেন নজরুল ইসলাম। হিন্দুরা বললো , আমাদের মা-কালীকে নিয়ে একজন মুসলমান গান লিখেছেন ? এত বড় স্পর্ধা ? এ কাজ যবন ছাড়া আর কেউ করতেই পারে না। হিন্দু দেবীর প্রতি ভক্তি দেখে কট্টর মুসলমান গনও ক্ষেপে যান। তাঁকে কাফের আখ্যা দেন কট্টর মুসলমানেরা।
বাংলা সাহিত্যের খুব কম সাহিত্যিক আছেন যাঁদের নিয়ে এমন চরম মাত্রায় সমালোচনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তালিকায় সবার শীর্ষে নাম রয়েছে কাজী নজরুলের। বিশেষত কট্টর পন্থী মুসলিমদের কবি নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণ ছিল তাঁর শ্যামা সঙ্গীত। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের ( তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ) কাজী নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজকের যুগে শ্যামা সঙ্গীতের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার আগে নাম আসে কাজী নজরূল ইসলামের। শ্যামা সঙ্গীতের মধ্য দিয়েও যে একটা নিঃশব্দ বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছেন কবি, সেটা বলাই বাহুল্য। তাঁর লেখা এবং সুর করা শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে পরবর্তী কালে অসংখ্য শিল্পী জনপ্রিয় হয়েছেন।
এখানেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, সঙ্গীতেও নজরুল ছিলেন জাতপাতের অনেক উর্ধে। তাঁকে বেড়া দিয়ে আটকে রাখার সাধ্য পৃথিবীর কারও ছিল না। এই আলোচনায় একটি বেসিক প্রশ্ন উঠে আসে এই যে, কাজী নজরূল ইসলাম একজন মুসলিম হওয়া সত্বেও তিনি শ্যামা সঙ্গীত লিখে গেলেন কেন ?
আপনারা জানেন, নজরুল ইসলামের প্রিয় ছেলে বুলবুলের মৃত্যু তাঁকে ভীষণ শোকাহত করেছিল। তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতাও তাঁকে গভীর ভাবে দিশে হারা করে দিয়েছিল। তাঁর সমসাময়িক গবেষকগণ বলেন যে, সেই সময় কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে শোক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এক আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। গবেষক বাঁধন সেনগুপ্ত তার বইতে কবির ব্যক্তিগত জীবনের অভাব প্রসূত জীবনের অন্তর্গত বিষাদের এই কারণটিকে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। তবে শুধু এই একটি কারণে কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামা সঙ্গীত বা মা কালীর সাধনার দিকে ঝুকে ছিলেন তা কিন্তু নয়। আরও একটি বড় কারণ ছিল। শৈশব থেকেই বিভিন্ন ধর্মের প্রতি কবির ছিল স্বভাব জাত গভীর এক আসক্তি। লেটু গান, বাউল গান, ভাটিয়ালী গান, কবি গান, বিভিন্ন গানের মাধ্যমেই লালিত হয়েছিল তাঁর ভিতরের সাধক সত্ত্বাটি।
গানের মধ্যেই কাব্যের এক বিমূর্ত রূপ নিয়ে আধ্যাত্বিক এক ভক্তি রসের স্পর্শ করেছিলেন। শ্যামা সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে এটিও একটি বড় কারণ।
আর সম্ভবত ছেলে বুলবুলের মৃত্যুর পর তিনি লালবোলা হাইস্কুলের হেড মাস্টার মশাই বড়দা চরণ মজুমদারের সংস্পর্শে এসে ছিলেন। বড়দাচরণ ছিলেন মূলত একজন কালী সাধক। বলাবাহুল্য,তাঁর প্রভাবেই নজরুলের কালী সাধনার শুরু এবং শ্যামা সঙ্গীতের জগতে তাঁর প্রবেশ। নজরুল ইসলামের শ্যামা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা হলেই আর একটা গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে উঠে আসে। প্রশ্নটি হলো নজরুল ইসলাম কি কালীর সাধক ছিলেন ? হ্যাঁ , এই বিষয়ে বিতর্ক আছে। তবে বিতর্ক থাকলেও আমরা দেখতে পাই যে, তিনি লালবোলা হাই স্কুলের হেড মাস্টার মশাই কালী সাধক বড়দাচরণ মজুমদারকে গুরু বলে সম্বোধন করেছিলেন। তিনি তাঁর গুরু সম্পর্কে তাঁর বই “ ভক্তিগীতি মাধুরী”র ভুমিকায় লিখেছেন, “ সহসা একদিন তাঁহাকে দেখিলাম। …শুভক্ষণে আনন্দ বাসরে আমার সে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম। … ..আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই, তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি। আমার ব্রহ্মক্ষুধা আজও মেটে নাই, কিন্তু সে ক্ষুধা এই জীবনেই মিটিবে, সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি। “ এই লেখাটি নজরুল প্রথম লিখেছিলেন “ পথ হারাবার পথ ও দ্বাদশ বাণীর “ প্রথম সংস্করণের ভূমিকা হিসাবে। পরে তা ব্যবহার করেন “ ভক্তিগীতি মাধুরী” সংকলনে। বলাবাহুল্য এই ”ভক্তিগীতি মাধুরী” ও দ্বাদশ বাণী বইটিতে তথ্য দেওয়া হয়েছে যে, নজরুল ইসলাম একজন হিন্দু গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে ছিলেন এবং সেই গুরুর নির্দেশেই তিনি কালী সাধক হয়ে ছিলেন। সেই গুরু আর কেউ নন তিনি হলেন লালগোলা হাই স্কুলের হেড মাস্টার মশাই বরদা চরণ মজুমদার। আর একটি বই আছে “ নজরুলের শ্যামাসাধনা এবং শ্যামাসংগীত”। বইটির লেখক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বদ্যিালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সাকার মুস্তাফা। এই বটিতেও আছে যে, গৃহ যোগী বরদাচরণ মজুমদারের কাছেই নজরুল ইসলাম তন্ত্র সাধনায় দীক্ষা নিয়ে ছিলেন। বরদা চরণ মজুমদারকে তিনি তন্ত্রগুরু হিসাবে বরণ করে ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর হিন্দু গুরু।
( চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২০:২৪:১৩ ● ৫৫৭ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ